নাগরিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতকরণ এবং উন্নত শহরের প্রত্যয়ে ২০১১ সালে গঠিত হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। এর বয়স এখন একযুগ চলছে। এই দীর্ঘ এক যুগে কী পেয়েছেন নগরবাসী, আর না পাওয়ার আক্ষেপটাই বা কোথায়? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নগরীর বিভিন্ন মহলের নেতারা। এতে আক্ষেপ অভিযোগ প্রকাশ পেলেও সিটি মেয়রের প্রতি আস্থা হারায়নি তারা।
তাদের মতে, সিটির কল্যাণে অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাড়লেও এই শহরে জনভোগান্তি লাঘব হয়নি আজও। নগর মাতাকে তাই সেই দিকেই নজর দেয়ার আহবান নাগরীকদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফুটপাতে হকার, শহুরে সড়কে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক আর এলোপাথারী গাড়ি পার্কিংয়ে যানজটের এক দূর্বিসহ নগরীতে রূপ নিয়েছে নারায়ণগঞ্জ। শহরের মোড়ে মোড়ে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্ট্যান্ড। এতে কিছু ব্যক্তির পকেট ভারি হলেও ভোগান্তিতে রয়েছে নগরবাসী। সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর পক্ষ থেকে বরাবরই অবৈধ হকারদের বিরোধীতা করা হলেও আলোচিত এক এমপি এবং তার অনুগতরা অবস্থান নিয়ে থাকেন হকারদের পক্ষেই। ওই এমপির অনুগত অনেকেই আবার বিভিন্ন পয়েন্টে অবৈধ স্ট্যান্ডও পরিচালনা করে থাকেন বলে অভিযোগ শোনা যায়।
সচেতমন মহল বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে ফায়দা লুটে থাকেন প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্তাব্যক্তি। প্রকাশ্যেই দেখা যায়, বিশেষ স্টিকারের মাধ্যমে অবৈধ গাড়ির চাঁকা যতটা ঘুরছে, ততটাই পকেট ভরছে কতিপয় ট্রাফিক সদস্যের। এতে নগরীর অব্যবস্থাপনা দূর হচ্ছে না। যার দায়টা দেয়া হচ্ছে মেয়রের কাঁধেই।
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট এবি সিদ্দিক দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু সড়ক ও ফুটপাত দখল করে নির্মিত আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনের বর্ধিত অংশ উচ্ছেদ করতে হবে। কারণ এতে মানুষ ও যান চলাচলে ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে। হকার ও যানজটকে নগরীর অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অটো রিকশা, বাস, ট্রাক চলাচলে কোনো নিয়ম নেই। তাছাড়া ফিটনেস বিহীন যানবাহন তো রয়েছেই। যার ফলে তীব্র যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে আমাদের। এতে করে নগরবাসীকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এর পাশাপাশি হকার সমস্যাতো রয়েছেই। এসব হকার প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ফুটপাতের পাশাপাশি রাস্তা দখল করে রাখে। কিন্তু প্রশাসন এবং সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কারই তা নজরে আসে না।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক আহŸায়ক অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, ‘নগরবাসী হিসেবে করের বোঝা মুক্ত নগর প্রত্যাশা করি। পাশাপাশি নগরবাসী যাতে নগরের সব সুবিধা ভোগ করতে পারে এমন নগর চাই। এছাড়া ফতুল্লাসহ শহরের আশপাশের প্রতিটি শহরতলীকে নগরের আওতায় আনার দাবি জানাই। এমন নগর প্রত্যাশা করি যে নগরে মানুষ নিরাপদে রাস্তায় চলাচল করতে পারবে এবং সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন শহরের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পেশা, শিক্ষা ও প্রকৃতির উপর কোন হুমকি থাকবে না।’
নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক খবরের পাতার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘এই শহরে বহু সমস্যা রয়েছে। এই শহরের রাস্তা-ঘাট অবৈধ দখলদারদের দখলে। সড়কে খুঁটি গেড়ে বসেছে অবৈধ স্ট্যান্ড। কিশোর গ্যাং এর উৎপাতে পাড়া-মহল্লাগুলোতে শ্বাস নেওয়া দুষ্কর। রাজনৈতিক মতপার্থক্য আর সরকারি কর্মচারিদের ভোগ করার মানসিকতায় ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকা তৈরি হলেও সিটি কর্পোরেশন ঠিকই শহরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে চলছে। যার অন্যতম একটি উদাহরণ হলো শেখ রাসেল পার্ক।’
নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি এবং দৈনিক ডান্ডিবার্তার প্রকাশক ও সম্পাদক হাবিবুর রহমান বাদল দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘যানজট নিরসনে নতুন সড়ক নির্মাণ করতে হবে। প্রতিদিনই শহরে যানবাহন ও মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই তুলনায় সড়কের সংখ্যা বাড়েনি, আগের মতই আছে। ফলে প্রতিনিয়ত যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। নগরীর ২নং রেলগেট এলাকা থেকে চাষাড়া পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণ করার কথা থাকলেও তা হয়নি। এছাড়া চাষাঢ়া ডাক বাংলোর বিপরিত পাশে একটি সড়ক নির্মাণ শুরু হয়েছিল যেটা দিয়ে সাইবোর্ড পর্যন্ত যান চলাচল করবে। কিন্তু এখনো এই রাস্তার কাজ হয়নি। এদিকে সিটি করপোরেশনকে নজর দিতে হবে।’
আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী সংগঠনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নূর উদ্দিন আহমেদ দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘নগরবাসী হিসেবে আমাদের যে প্রত্যাশা তা শতভাগ পূরণ হয়নি। অটো রিকশা, বাস, ট্রাক চলাচলে কোনো নিয়ম নেই। যার ফলে তীব্র যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে আমাদের। এতে করে নগরবাসীকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এর পাশাপাশি হকার সমস্যাতো রয়েছেই।’ তিনি বলেন, নগরীর জিমখানা বস্তি উচ্ছেদ করে সেখানে শেখ রাসেল পার্ক নির্মাণ করায় নগরবাসীর উপকার হয়েছে। কারণ এমন কোন অপকর্ম নেই যে এই বস্তিতে না হতো। বিভিন্ন অপরাধিরা অপরাধ কর্মকান্ড করে এখানে আশ্রয় নিত। তা ছাড়া এই বস্তিতে যারা মাদক কারবারি ও সেবনের সাথে যুক্ত ছিল তাদের সাথে মিশে এ এলাকার আশপাশের মহল্লার ভালো পরিবারের সন্তানদের মাদকসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা ছিল। অনেক ভাল পারিবারের ছেলে তাদের সাথে মিশে মাদক সেবনে জড়িয়েছে বলেও জানা যায়। এই বস্তি উচ্ছেদের কারণে আশপাশের এলাকার আমুল পরিবর্তন হয়েছে। এর জন্য মেয়রকে ধন্যবাদ জানাই।’
মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জি এম আরাফাত দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘সুন্দর নগরীর অন্তরায়ে প্রধান সমস্যা হলো যানজট। পাশাপাশি হকার সমস্যাটাও ভোগাচ্ছে নগরবাসীদের। নগরবাসী হিসেবে আমাদের যে প্রত্যাশা তা হয়তো শতভাগ পূরণ হয়নি। কিন্তু মেয়র যতটুকু করেছে তা কমও না। তিনি পার্ক, মাঠ, রাস্তা, কালভার্ট, ড্রেন, লেকসহ নানা ধরণের স্থাপনা করেছেন। এ চাওয়াগুলো অনেকদিনের ছিল। তা তিনি পূরণ করতে পেরেছেন। সামনের দিকে তিনি আরও কাজ করার চেষ্টা করছেন। হয়তো আমরা তার কাছ থেকে আরও ভালো কিছু কাজ পাবো।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘একজন নগরবাসী হিসেবে একটি নিরাপদ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন নগর প্রত্যাশা করি। এছাড়া মাদক, সন্ত্রাস, কিশোরগ্যাং, অপরাধ ও দুষণ মুক্ত একটি নগরীর প্রত্যাশা করি। আমি এমন নগর প্রত্যাশা করি যে শহরে নিরাপদে রাস্তায় চলাচল করতে পারব এবং হকার ও যানজট মুক্ত থাকবে। পরিবেশ, বায়ু, ও নদী দুষণ হবে না। ফুটপাত ও নদী দখল মুক্ত থাকবে। নগরে কোন সন্ত্রাস, কিশোরগ্যাং, ছিনতাইসহ কোন অপরাধ থাকবে না। আর যে দিন এই সব সমস্যার সমাধান হবে ওই দিন নগরবাসী হিসেবে আমার যে প্রত্যাশা তা পূরণ হবে।’