আজ বুধবার, ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

টানবাজার নিয়েও আশঙ্কা

চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে রাসায়নিক যৌগ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের আগুন এখনও জ্বলছে। এ পর্যন্ত সোনাইছড়ির বিএম কনটেইনার ডিপো থেকে ৪৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের মত এমন দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে নারায়ণগঞ্জ শহরেও। প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ শহরের অন্যতম বাণিজ্যক এলাকা টানবাজারে বসবাসরত মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে দিন-যাপন করছেন। কবে যেন এখানেও এমন ঘটনা ঘটে!
দীর্ঘদিন যাবৎ শহরের ব্যস্ততম ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা টানবাজারের বিভিন্ন রকম কেমিক্যালের ব্যবসা হয়ে আসছে। টানবাজারে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) মালিকানাধীন পদ্ম সিটি প্লাজা-১, ২ ও ৪ এর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় এবং হাজী প্লাজার নিচতলাসহ এর আশেপাশে প্রায় দেড় শতাধিক ছোট-বড় কেমিক্যালের দোকান, প্রতিষ্ঠান ও গোডাউন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান, দোকান ও গোডাউনে এসিড, নাইট্রেট, সফেনার, ডাইস কেমিক্যাল, প্রিন্টিং কেমিক্যাল মজুত আছে। এছাড়াও রয়েছে অতিরিক্ত তাপে ভয়ানক দাহ্য ‘হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড’ এর মতো যৌগও। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এসব কেমিক্যাল মজুত ও বিক্রি চলছে দিনের পর দিন।

সরেজমিনে দেখা যায়, টানবাজারের পদ্ম সিটি প্লাজা-১, ২ ও ৪, হাজী প্লাজার নিচতলসহ এর আশেপাশের একাধিক বহুতল ভবনের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালের দোকান। এসব দোকানে পাইকারি ও খুচরা দরে বিক্রি হয় বিভিন্ন কেমিক্যাল। দোকানের সামনে রাস্তায় সারি সারি ছোট-বড় ড্রামে রাখা হয় এসব কেমিক্যাল। এ সকল ভবণ ও দোকানগুলোতে নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স। তবু দোকানগুলোর অধিকাংশের কাছে আছে ট্রেড লাইসেন্স। এসকল দোকানগুলো টানবাজারে হলেও এর গোডাউন শহরের অন্য ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা সাহাপাড়া, মিনাবাজার, টানবাজার পুলিশ ফাঁড়ির আশেপাশে ও নিতাইগঞ্জে অবস্থিত।

একাধিক ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায়, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড একট অনুমোদিত কেমিক্যাল। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডকে ইউনিভারসাল ব্লিচিং এজেন্টও বলা হয়। কারণ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড দিয়ে সব ফাইবার ব্লিচিং করা যায় আর এর ব্যবহারে ফাইবার ড্যামেজ হয় না। ফলে শিল্প প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ডাইং কারখানায় বিপুল পরিমাণে এর ব্যবহার করা হয়। বস্ত্রশিল্পে সমৃদ্ধ নারায়ণগঞ্জে হাজারেরও অধিক ডাইং কারখানা রয়েছে। যার সিংহভাগই সদর উপজেলায় অবস্থিত। আর এসকল ডাইং কারখানাগুলো টানবাজার থেকে তাদের প্রয়োজনীয় হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড সংগ্রহ করে। সূত্রমতে, টানবাজারের কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন যাবত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের ব্যবসা করে আসছে। তারা সরাসরি জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এটি আমদানি করেন। সাধারণভাবে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড দাহ্য না হলেও অতিরিক্ত তাপমাত্রায় এটি দাহ্য একটি পদার্থ।

পদ্ম সিটি প্লাজা-২ এর নিচতলার কেমিক্যাল মো. আরিফ বলেন, ‘আমরা কোনো দাহ্য পদার্থ বা কেমিক্যাল রাখি না। বিক্রিও করি না। আমাদের কাছে যে সকল কেমিক্যাল আছে সবগুলোর অনুমোদন আছে। আমরা রঙ ও এর কাজে ব্যবহৃত সাধারণ কেমিক্যাল বিক্রি করি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড অনেক কাজে ব্যবহার করা হয়। আর এই কেমিক্যাল বিক্রির অনুমোদনও আছে। নারায়ণগঞ্জে এই কেমিক্যালের চাহিদা অনেক, তাই আমরাও বিক্রি করি।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির জেলা সভাপতি হাফিজুর ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ডাইং কারখানাসহ বিভিন্ন কাজে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ব্যবহার করা হয়। এ কারণে টানবাজারেরসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মজুদ রাখা হয়। প্রশাসন এর অনুমোদন দেয় কিন্তু ব্যবসায়ীরা এই কেমিক্যাল মজুদে যে নিয়ম আছে তা মানছে কিনা তা তারা মনিটরিং করেন না। যার ফলে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে। প্রশাসনের কাছে আবেদন আমাদের আবেদন, টানবাজারের মত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন স্থানান্তর ও এর মজুদে সুনির্দিষ্ট নিয়ম মানার বিষয়টি মনিটরিং করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ পরিচালক আব্দুল আল আরিফিন বলেন, ‘টানবাজারের কেমিক্যাল দোকানীদের অনেকেই আমাদের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়েছে। তবে অধিকাংশই লাইসেন্স ছাড়া। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের মত দাহ্য পদার্থ বিক্রি ও মজুদ করলেও তা আমাদের জানান নেই। কারণ আমরা পরিদর্শনে গিয়ে তেমন কোনো দাহ্য পদার্থ দেখতে পাই না। এর একটি কারণ এসকল পদার্থ তারা গুদামে মজুদ রাখে, দোকানে রাখে না। তবে আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবো। আগামী সপ্তাহে জেলা প্রশাসক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমরা বসবো যাতে তারা কেমিক্যাল গুদামগুলো জনবসতি থেকে সরিয়ে নেয়া।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রশাসন ও আমাদের জনবল সীমিত আর লুকানো কেমিক্যাল মজুদের বিষয়ে আমাদের তেমনকিছু করার নেই। তবে আমারা সীতাকুন্ডের মত দুর্ঘটনা নারায়ণগঞ্জে চাই না। তাই আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে গুদামগুলো সরানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’