আজ বুধবার, ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পাটজাত পণ্যের বাহারি সমাহার

এম.এ মোমেন :

বাণিজ্য মেলায় দৃষ্টিনন্দন পাটজাত পণ্যের বাহারি সমাহার ক্রেতাদের আকর্ষণ করছে। ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষের তালিকায় রয়েছে পাটের তৈরি পণ্য। যেমন পছন্দ তেমন বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর। অন্যান্য পণ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বিক্রি হচ্ছে পাটের তৈরি এসব পণ্য। এর চাহিদা বেশি। দাম কম। ক্রেতারাও ভালো মানের ও টেকসই পাটের তৈরি সামগ্রী ক্রয়ে ঝুঁকছেন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসির) প্যাভিলিয়নে ১৬টি স্টল রয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ভারি পাট শিল্পের এসকল স্টলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্রেতাদের ভিড় জমে। তবে বিকেল থেকে জমজমাট হয়ে উঠে এসকল স্টল।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাণিজ্য মেলার পাটজাত পণ্যের স্টলগুলোতে ল্যাপটপ ব্যাগ, ফ্লোর ম্যাট, অফিস ব্যাগ, টেবিল রানার, লেডিস ব্যাগ, ফ্রুট বক্স, ট্রাভেল ব্যাগ, ওয়াইন ব্যাগ, অফিস ব্যাগ, নার্সারী পট, জুট অর্নামেন্ট, জুট পর্দা, লেডিস পার্স, বেডশিট, কলেজ ব্যাগ, স্যান্ডেল, অফিস ফোল্ডার, টিস্যুবক্স, কলমদানি, ভ্যানিটি ব্যাগ, কবি ব্যাগ, টিফিন ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, লেডিস বটুয়া, শো-পিছ, ক্যাপ, ফেব্রিক্স, ঢোল ব্যাগ, টেবিল ম্যাট, টি ম্যাট, রুম ম্যাট, রাইস ম্যাট, ওয়াল ম্যাটসহ ৬০ থেকে ৭০ ধরণের পাটের তৈরি পণ্য স্থান পেয়েছে। ১২০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকা পাটের তৈরি মূল্যের পণ্যের চাহিদা বেশি। তবে বেশি দামের পণ্যের চাহিদা কম। পাটের সুতা, ব্যাগ, হোগলা পাতার সংমিশ্রণে তৈরি করা পণ্যও স্টলে স্থান পেয়েছে। মেশিন আর হ্যান্ড লোমে এসব পণ্য তৈরি করা হয়। পাটজাত পণ্যকে দেশের ভেতরে জনপ্রিয় করতে সরকার দেশের কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ করেছে বলেও স্টলের মালিকরা জানিয়েছে। পাট থেকে বস্তা, ফ্রেব্রিক, হ্যান্ডব্যাগ, কার্পেট, শাড়ি, পর্দা, জুতা, সোফা, শো-পিছসহ শত শত রকমের পণ্য তৈরি করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপ, আমেরিকাতেও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বেড়েছে।

একসময় পাটকল রাজধানী শহরের আশপাশে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু রূপগঞ্জেই ১১টি পাটকল চলমান ছিল। তখন পাটকল বিদেশি পুঁজিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কম শ্রম মূল্যে কাঁচা পাটের সহজ লভ্যতা, দীর্ঘ সময় কাজ করানো এবং অধিকতর মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করা হতো। ১৯২৯-৩০ সালে দেশে ৫৮টি পাটকল ছিল। একসময় বিজেএমসি ধীরে ধীরে কাঁচা পাট ক্রয়, বিক্রয়, অর্থ জোগান, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তখন থেকেই পাটকলের ব্যবসায় ভাটা পড়ে।

১৯৫২ সালে বাংলাদেশের সোলালী আঁশ নামে পরিচিত পাটশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। নারায়ণগঞ্জে প্রথম স্থাপিত হয় এশিয়ার বৃহত্তম আদমজী পাটকল। পরবর্তীতে দূর্নীতি, অদক্ষতা, অযোগ্যতা এবং অব্যবস্থাপনায় একের পর এক পাটকল বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিক ছাঁটাই এবং মজুরি না দেওয়ার কারণে পাট শিল্পে কাজ করতে অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পাটের সোনালী আঁশ নামটি যেন বিস্মৃত প্রায়। অর্থকারী ফসল হলেও সেই সোনালী দিন এখন আর নেই। পাটের পলিমার থেকে যেটা পচঁনশীল সেই ধরণের ব্যাগ তৈরি হচ্ছে যার নাম সোনালী ব্যাগ। এই সোনালী ব্যাগ পরিবেশ দূষণ করবে না। সেকারণে স্টলে এসকল ব্যাগের চাহিদা রয়েছে প্রচুর।

নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া থেকে আসা গৃহবধূ নুসরাত জাহান তৃশা বলেন, দৃষ্টিনন্দন পাটজাত পণ্যের বাহারি সমাহারে আমি মুগ্ধ। হাতের তৈরি পাটের পণ্য দাম কম হওয়ায় আমি স্কুল ব্যাগ, লেডিস সাইড ব্যাগ ক্রয় করেছি। 

রূপগঞ্জ থেকে আসা গৃহবধূ তাবিয়া ফাতেমা বলেন, দাম একটু বেশি হলেও নির্ভিঘ্নে তা ব্যবহার করা যায়। সেকারণে আমি পাটের তৈরি পণ্য স্টল থেকে ক্রয় করেছি।

পাটের তৈরি পণ্যের স্টলের বিক্রয় প্রতিনিধি আলম শেখ বলেন, প্রচলিত বয়ন শিল্পে পাটের, সুতা, পাকানো সুতা, বস্তা, চট, কার্পেট, ব্যাকিং, পর্দার কাপড়, কুসন কভার পাট থেকে তৈরি হয়। গরম কাপড় তৈরির জন্য উলের সঙ্গে পাটের মিশ্রণ করা হয়। এসকল পণ্যের দাম তুলনামূলক ভাবে কম। তাই এ পণ্যের চাহিদা বেশি বিক্রি হচ্ছে দেদারসে।

ময়না জুট বাজারের বিক্রয় প্রতিনিধি রিমন মিয়া বলেন, পাট বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল। সোনালী আঁশের সমাদৃত বিশ্বব্যাপী। মাটির গুণাগুণ ও জলবায়ু অনুকূলে থাকায় বাংলাদেশে উন্নতমানের পাট উৎপাদিত হচ্ছে। সেই সকল পাটেই পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর।

বেঙ্গল ব্রেইডেড এন্ড রাগস লিমিটেডের বিক্রয় প্রতিনিধি আল-উদয় রহমান বলেন, টেকসই, পরিবেশ বান্ধব ও সবুজ উন্নয়নের লক্ষে পাটের পণ্য ব্যবহারে ঝুঁকছে মানুষ। প্রক্রিয়াজাতকরণে পাট পণ্য তৈরি করা হয়। তাতে পাটের তৈরি পণ্যেরও ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

হ্যারিটেজ ইকো প্রোডাক্টসের ব্যবস্থাপক মোঃ জোবায়ের হোসেন বলেন, বৈসিক বাজারের দখলে কৌশলগত ত্রুটি, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, অদক্ষ ও বেশি সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগে দিন দিন এ শিল্পে ভাটা পড়েছে। কিন্তু গৃহস্থালির কাজে পাটের তৈরি পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। 

কুষ্টিয়া থেকে আসা গৃহবধূ হালিমা আক্তার বলেন, পাট দিয়ে যে এতো বৈচিত্রপণ্য জিনিস তৈরি হয় সেটি তার জানা ছিল না। একটা সময় মনে করা হতো পাট দিয়ে শুধু চটের ব্যাগ তৈরি করা হয়। কিন্তু সে ধারণা এখন আর নেই। কুষ্টিয়ার লালন মেলায় পাটের তৈরি পণ্যের চাহিদা ও বিক্রি অনেক।

প্রকৃতি স্টলের বিক্রয় প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম বলেন, বলেন, দেশের ভিতরে পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিশিদ্ধ করে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করা হলে পাটের বিপুল চাহিদা হবে।

হলি ক্রাফটস এন্ড ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক মোঃ কামাল হোসেন বলেন, পাটশিল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে। পাটের তৈরি অনেক জিনিসপত্র এখন দেশ বিদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

ক্রিয়েটিভ জুট টেক্সটাইল প্রোডাক্সের ব্যবস্থাপক অর্পণ দাস বলেন, পাট ও তুলার মিশ্যণে তৈরি ব্যাগ রপ্তানি করা হচ্ছে। পাট দিয়ে শাড়ি, লুঙ্গি, খেলনা, বাহারি ব্যাগ, শো-পিছ, ওয়াল ম্যাট, পাপোস, জুতা, স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানার পর্দার কাপড়, গহণা ও টিস্যুবক্সসহ ২৮৫ ধরণের পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে। মেলায় পাটের তৈরি ৬০/৭০ ধরণের পণ্য স্থান পেয়েছে।

বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীক বলেন, পাটের সু-দিন ফিরিয়ে আনতে পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাটের তৈরি পণ্য ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে হবে। পাট চাষিদের লাভবান করতে হবে। পাটকে অর্থনৈতিক সম্পদে পরিণত করতে হবে। তবেই দেশ এগিয়ে যাবে।