সাবিত আল হাসান
বাঙালির চা প্রীতির অভ্যাস বেশ পুরোনো। তার সাথে যুক্ত হয়েছে স্বচ্ছ কাচের কাপ যা কেবল চা রাখলেই সকলের নিকট মানানসই হয়ে উঠে। পাড়া মহল্লার টঙের দোকান থেকে শুরু করে অভিজাত শ্রেণির পারিবারিক আড্ডাতেও দেখে মেলে স্বচ্ছ কাপের ব্যবহার।
সেই দীর্ঘদিনের অভ্যাস পাল্টে দিতে বাধ্য হয়েছে এই নগরীর বাসিন্দারা। মরণব্যাধী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে কাঁচের পাত্রের বদলে হাতে তুলে নিয়েছেন থার্মোকল ও প্লাস্টিকের কাপ। ঘরোয়া ভাবে এর ব্যবহার না থাকলেও চা বিক্রেতার দোকানগুলোতে এর প্রয়োগ বেশ ভালোভাবেই চলছে। অথচ গরম পানীয়র সাথে প্লাস্টিক ও থার্মোকলের সংস্পর্শ যে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে সে সম্পর্কে অবগত নন কেউই।
করোনা এসে পালটে দিয়েছে বেশ কিছু সাধারণ অভ্যাস। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষজন আগের তুলনায় আরও বেশী সচেতন হয়েছে। রাস্তায় চলাফেরা এবং বাহিরের খাবার গ্রহণেও বেশ সচেতন সকলেই। সেই ধারাবাহিকতায় বাঙালির চা পানেও এসেছে ভিন্নতা। চিরচেনা কাঁচের কাপের বদলে জুটেছে প্লাস্টিক বা থার্মোকল কাপ। চা পান শেষে যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হচ্ছে এসকল কাপগুলো। সিটি কর্পোরেশন দিনে একবার এসব বর্জ্য পরিষ্কার করে গেলেও বেশ কিছু অংশের স্থান হয় রাস্তার পাশের ড্রেনে। প্লাস্টিকের এমন দূষণ নতুন কিছু নয় আমাদের নিকট। কিন্তু এসকল কাপে চা পানের প্রতি চুমুকেই শরীরে প্রবেশ করছে বিষ। দীর্ঘদিন এই অভ্যাস ধরে রাখলে মানবদেহে বাসা বাঁধবে ক্যান্সারের মত মরনব্যাধী।
শহরের আশেপাশে চা পানের জন্য টঙের দোকান থেকে অভিজাত দোকান যেখানেই যাওয়া হোকনা কেন, সর্বত্রই ডিসপোজেবল কাপের ছড়াছড়ি। স্বচ্ছ প্লাস্টিক, সাদা প্লাস্টিক, এবং কাগজ এবং প্লাস্টিকের সংমিশ্রণে নেসক্যাফের কাপেরও দেখা মেলে এসকল চায়ের দোকানে। ডিসপোজেবল কাপে পরিবেশনের ফলে খুব বেশী খরচও হয়না দোকানীদের। অথচ গরম পানীয় ফুডগ্রেড বিহীন প্লাস্টিকে পরিবেশন করলে সেখানে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে সেই সম্পর্কে ক্রেতা বিক্রেতা কারোই ধারণা নেই।
জানা যায়, পাতলা প্লাস্টিক তৈরীতে ব্যবহার করা হয় ডাইঅক্সিন, ক্যাথালিন, ডিক্সেনাল-এ সহ বেশকিছু রাসায়নিক। যখন প্লাস্টিকে গরম কিছু পরিবেশন করা হয় তখন এসকল দ্রব্য তরলের সাথে মিশ্রিত হয়ে দেহের ক্ষতি করে থাকে। এছাড়া থার্মোকলে থাকে থার্মোপ্লাস্টিক যৌগ পলিস্টাইরিন। দীর্ঘদিন এর ব্যবহার লিম্ফোমা লিউকোমিয়া ক্যান্সার ডেকে আনে। এছাড়া প্লাস্টিকের উপাদান দেহে প্রবেশের ফলে পুরুষ সন্তান জন্মদান করার ক্ষমতা হ্রাস পায়।
চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি দেশের সকল উপকূলীয় অঞ্চলে ডিসপোজেবল পন্য ১ বছরের মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বিশেষ করে কটন বার্ড, প্লাস্টিকের বোতল, কাপ, প্লেট, ফুড প্যাকেজিং সহ ওয়ানটাইম সকল প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। সমুদ্র ও সামুদ্রিক প্রানীর জীবন রক্ষায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অথচ এসকল পন্য ব্যবহারে মানুষের তার দেহের বিপর্যয় ডেকে আনছে সেদিকে লক্ষ খুবই কম।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি গবেষক ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ কর্মী মাহবুব সুমন বলেন, থার্মোকল এবং প্লাস্টিক কাপ ব্যবহারে মানুষ তার নিজের ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনছে। উন্নত বিভিন্ন দেশে বর্জ্য ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ডাম্পিং জোনে সতর্কতার সাথে এই প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এর ব্যবহারেই যে ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনতে পারে সেই সম্পর্কেই মানুষ অবগত নন। আমাদের অনেকেই প্লাস্টিকের কাপ যত্রতত্র ফেলে পরিবেশকে দূষিত করে আসছি। এসব প্লাস্টিক পানিতে মিশ্রিত হয়ে মাছ বা অন্যান্য মাধ্যমে আমাদের দেহে ফিরে আসছে। সুতরাং এই দূষণকে কোনভাবেই খাটো করে দেখা সম্ভব না।
দূষণ রোধে করনীয় কি এমন প্রশ্নে মাহবুব সুমন বলেন, শুধুমাত্র চায়ের কাপেই বড় দুষন হচ্ছে ব্যাপারটা এমন নয়। চায়ের কাপের মাধ্যমে বিষ প্রবেশ করছে আমাদের দেহে। সেক্ষেত্রে দেশীয় পন্য মাটির কাপ ব্যবহার করা যেতে পারে যা পাশের দেশ ভারতে বেশ প্রচলন রয়েছে। এছাড়া সচেতন ভাবে নিজের জন্য একটি পানির কাপ বহন করে তাতে চা – কফি পানের অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে করে করোনা ও প্লাস্টিক বিষ উভয় থেকেই নিস্তার মিলবে।