আজ শুক্রবার, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পরিচালক গার্মেন্টসে, শিক্ষক ডাইংয়ে আর শিক্ষার্থীরা হোসিয়ারীতে

লিপি ওসমানের নামে নামকরন করা স্কুলটির

অবশ্যই স্কুলটির বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে- অয়ন ওসমান

নিজস্ব প্রতিবেদক

নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের সহধর্মিনী ও জেলা মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান সালমা ওসমান লিপির নামে নামকরণ করা স্কুলটির যে পরিচালনা করতেন সেই স্কুলের উদ্যোক্তা নাছির গাজী এখন ফকির নিট গার্মেন্টসে কাজ করেন। আর সেই স্কুলের শিক্ষক কাজ করেন ডাইংকে, শিক্ষার্থীরা কেউ হোসিয়ারীতে কেউ আবার ছোট খাটো দোকানে। কিন্তু কেন? এমন প্রশ্ন এলাকাবাসীর।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার কায়েমপুরে অবস্থিত লিপি ওসমান শিশু নিকেতন স্কুল। উদ্যোক্তা নাছির গাজীর হাত ধরে ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারী স্কুলটির যাত্রা শুরু হয়। যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ২৫জন কিন্তু ধীরে ধীরে তা রুপ নেয় প্রায় ৭০জনে।

মূলত ছিন্নমূল শিশুদের জন্য “লিপি ওসমান শিশু নিকেতন স্কুল” নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছিলেন মো: নাছির গাজী। তার এই স্কুলে ওই এলাকার শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতো। সেই সময় উপজেলা শিক্ষা অফিসে আবেদন করে বিভিন্ন সহযোগীতা নেওয়া হয়। এছাড়াও এলাকাবাসীর উদ্যোগে বিভিন্ন শিক্ষা সামগ্রী ক্রয় করা হয়। তবে তার কিছু দিন পর পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশের পর সেই স্কুলটির দায়িত্ব নেয় জেলার প্রভাবশালী ওসমান পরিবার। তথা প্রভাবশালী সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের পুত্র এড. অয়ন ওসমান। স্কুলটি পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়ার পর অয়ন ওসমানের পক্ষ থেকে অনুদান দেন মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ। তারই ধারাবাহিকতায় বেশ ভালোই চলতে থাকা স্কুলটি হঠাৎ একদিন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শুধু স্কুল নয় ২০১৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী ফতুল্লার কায়েমপুরস্থ ষাট বাড়িতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় সেই বাড়িতে থাকা লিপি ওসমান শিশু নিকেতন সহ আরও ৬০টি বাড়ি আগুনে পুড়ে যায়। পুড়ে যায় ৭০জন শিশুর স্বপ্ন। স্কুলটি পুড়ে যাওয়ার ১০মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি ওসমান পরিবারের পক্ষ থেকে। ফলে দরিদ্র ছিন্নমূল শিশুগুলো শিক্ষা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। অর্থের অভাবে বেশ কিছু শিশু এখন হোসিয়ারী কিংবা ঝুটের গোডাউনে কর্মরত আছেন। আর সেই স্কুলে পাঠদানকারী শিক্ষক কাজ করেন ডাইংকে। স্কুলের উদ্যোক্তা নাছির গাজী কোন দিশা না পেয়ে এখন ফকির নিট গার্মেন্টসে কাজ করছে।

এ বিষয়ে স্কুলের উদ্যোক্তা নাছির গাজীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি দৈনিক সংবাদচর্চাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে এই স্কুলটির পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমি ছোটবেলায় পড়াশুনা করতে না পারায় সবসময় মাথার ভিতর একটা জিনিসই কাজ করতো। আর সেটা হলো হতদরিদ্র কিংবা ছিন্নমূল শিশুরা যেন কখনই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়। আর তাই আজ থেকে ৩বছর আগে আমি অল্প কিছু শিশু নিয়ে আমার এলাকার শিক্ষিত কিছু ছোট ভাইয়াদের মাধ্যেমে এই স্কুল পরিচালনা করতাম। কিন্তু পরবর্তীতে ওসমান পরিবার এই স্কুলের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এবং বিভিন্নভাবে আমাকে সহয়তা করে। তথা অয়ন ওসমান নগদ ৫০হাজার টাকা এই স্কুলে অর্থ অনুদান দেয়।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্নভাবে ওসমান পরিবার আমাদের এই স্কুলটির ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগীতা করেছে। কিন্তু একটি দূর্ঘটনায় স্কুলটি পুড়ে যায়। সেই থেকে স্কুলের সব শিক্ষার্থী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। এবং পুরোপুরি শিক্ষা থেকে তারা এখন বঞ্চিত। আমি চাই পুনরায় যাতে ওসমান পরিবার এই স্কুলটির বিষয়ে একটু দৃষ্টি দেয়। তাহলেই আবার এই হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুগুলো শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে।

এলাকাবাসী জানায়, ওসমান পরিবার নারায়ণগঞ্জে অনেক স্কুল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য সহযোগীতা করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় লিপি ওসমানের নামে নামকরণ করা স্কুলটিতে তারা বিভিন্নভাবে অনুদান দিয়েছে। কিন্তু অগ্নিকান্ডে স্কুলটি পুড়ে যাওয়ায় এখন স্কুলের শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তারা কেউ কেউ হোসিয়ারীতে কাজ করে আবার কেউ করে দোকানে। স্কুলটি পুড়ে গেছে আজকে ১০মাস হতে চললো। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ওসমান পরিবারের পক্ষ থেকে কোন আশ্বাস আমরা পায়নি।

ওসমান পরিবারের দৃষ্টি আকর্ষন করে তারা আরও বলেন, ছাত্রলীগের কিছু নেতারা বলেছিলেন স্কুলটি পুনরায় তৈরী করা হবে। কিন্তু কই? আর কবে তৈরী করা হবে স্কুলটি। এভাবে চলতে থাকলে শুধু ৭০জন নয় এই এলাকার সকল হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। এবং শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হলে তারা ভবিষ্যতে ভয়াবহ রুপ ধারণ করতে পারে। তাই অতি শীঘ্রই ওসমান পরিবারের এই স্কুলটির বিষয়ে একটু দৃষ্টি দেয়া দরকার। আর তাহলেই ছিন্নমূল শিশুগুলো শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে।

এ বিষয়ে সাংসদ শামীম ওসমানের একমাত্র পুত্র এড. অয়ন ওসমান দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, স্কুলটির অগ্নিকান্ডের বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। তাছাড়া এ বিষয়ে এলাকাবাসী বা স্কুল কৃর্তপক্ষ আমাকে কিছুই জানায়নি। আমি অতি শীঘ্রই স্কুলে আমার লোক পাঠাবো এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য। যেহুতু স্কুলটি আমার মায়ের নামে নামকরণ করা সেহুতু অবশ্যই স্কুলটির বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। এবং হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল কোন শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকবে না।

এ বিষয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাফায়েত আলম সানি বলেন, ওই স্কুলের বিষয়ে আমরা আর্থিক সহযোগীতা করেছি। তথা ভাবির (সালমা ওসমান) সহয়তা এবং অয়ন ওসমানের পক্ষ থেকেও আর্থিক সাহায্য-সহযোগীতা করা হয়েছে। আমরা শিক্ষকদের বেতন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য খাতা-কলমসহ সকল শিক্ষা সামগ্রী গুলো জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে অনুদান দিয়েছি। এর পাশাপাশি ভাবি তাদের ড্রেস, খাবার এবং অনেক পরিবারের ঈদের সকল সামগ্রী সবকিছুই দিয়েছেন তিনি। আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর আমরা অনেক পরিবারকে সাহায্য-সহযোগীতা করেছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা স্কুলটি পুনরায় করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু স্কুলে যেই শিক্ষার্থী গুলো ছিলো তারা যেকোন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। ফলে তাদেরকে আর একত্রে পাওয়া যায়নি। তখন স্কুলে ৭০জন শিক্ষার্থী ছিলো এখন ১০জনও খুজে পাওয়া যাবেনা। কাজেই স্কুল করার আগে ছিন্নমূল শিশুদেরকে একত্রিত করে তারপর আমরা স্কুলের বিষয়ে পদক্ষেপ নিবো।

মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ বলেন, একটা স্কুল যখন শুরু হয় তখন স্কুলের জন্য অনেক কিছু প্রয়োজন হয় আর সেই প্রয়োজন গুলো তখন দেয়া হয়েছিলো। অয়ন ওসমানের পক্ষ থেকে আর্থিক সাহায্য-সহযোগীতাও করা হয়েছে। ওই অগ্নিকান্ডের বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। আমরা জানতে পেরেছি সেই অগ্নিকান্ডের ঘটনার বিষয়ে। যেহুতু আমরা ছাত্র মানুষ সেহুতু আমাদের আর্থিক অবস্থাটা বেশী ভালো না। এ বিষয়টি উপরের মহলে আমরা জানাবো। আমরা চাই যে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে হোক আর যেভাবেই হোক যারা পথ শিশু আছে আমরা তাদের পাশে আমরা সবসময়ই থাকবো। তাদেরকে সাহায্য-সহযোগীতা করা হবে।

তিনি আরও বলেন, এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে তেমন কোন আবেদন করা হয়নি। যেহুতু লিপি ওসমানের নামে স্কুলটির নামকরন করা সেহুতু অবশ্যই আমরা এ বিষয়টি দেখবো। আমরা সবসময়ই চিন্তা করি যাতে পথশিশু, হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুগুলো যাতে কোনভাবেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়। কারণ তারাও একদিন বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ন পদে কাজ করবে। এবং তারাই বাংলাদেশের ভবিষ্যত।</নষড়পশয়ঁড়ঃব>