নিজস্ব প্রতিবেদক:
নারায়ণগঞ্জের গোগনগরে নিহত মডেল কন্যা মাহমুদা ওরফে তানিশা হত্যাকান্ড নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে শহরময়। শহরের কালীরবাজারে স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষ হত্যাকান্ডের রেশ কাটতে না কাটতে আরেকটি লোমহর্ষক হত্যাকান্ড শহরময় আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গোগনগরে নিহত মাহমুদাকে নিয়ে ধোঁয়াশায় তার প্রতিবেশি থেকে শুরু করে তার নিকটাত্মীয়রাও। কেউ ঠিক করে বলতে পারছেই না কি করে মাহমুদা। শুধু এটুকুই জানা মডেলিং ও শহরের উকিলপাড়ার টপটেন নামক দোকানের সেলস ম্যান হিসেবে কাজ করতেন মাহমুদা। বেপরোয়া ও উচ্চাবিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত মাহমুদা একটি শর্ট ফিল্মে নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন তানিশা খাঁন।
নিহত মাহমুদার গোগনগরের প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, এই ফ্ল্যাট যাঁরা (মাহমুদা) ভাড়া নিয়েছিলেন তাঁদের সাথে তেমন দেখা সাক্ষাত হতো না। কথাও হতো না। তাই তাঁরা কে কি করেন, নাম কি, সে কিছুই জানতে পারেনি। পুলিশও উদ্ধার করা লাশটি অজ্ঞাত হিসেবে ময়না তদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করেন।
তানিশার পারিবারিক সূত্র থেকে জানা গেছে, গত ১ মাস ২০ দিন আগে গোগনগর আলামিন নগর এলাকায় মাহমুদা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে তা তাঁর পরিবার তথা বাবা-মা কেউই জানতেন না। সর্বশেষ তাঁরা জানলেন সোমবার (৩০ জুলাই) রাতে মাহমুদার লাশ উদ্ধারের পর।
যদিও এদিন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশ প্রথমে অজ্ঞাত হিসেবে মাহমুদার লাশ উদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু পরে শনাক্ত করা গেছে তাঁর পরিচয়। এরমধ্যে একটি সূত্র জানিয়েছে, মাহমুদার মরদেহের নিচে একটি কাগজে তাঁর পরিবারের নাম্বার লিখে রেখেছিলো কেউ একজন। ধারণা করা হচ্ছে হত্যার পর খুনী নিজেই ওই নাম্বারটি লিখে রেখেছিলেন।
বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলেও উচ্চ বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত বন্ধুদের সহাচার্যে নিজেও হয়ে ওঠেছিলো বেপরোয়া। স্বপ্ন ছিলো মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া। ফলে মাহমুদা থেকে হয়ে ওঠেছিলো তানিশা খাঁন।
পরিবারের কাছে এই নামে সে পরিচিত না হলেও বিভিন্ন মহল তাঁকে তানিশা খাঁন নামেই চিনতেন, জানতেন। ‘মর্ডান মেয়ে’ নামে একটি শর্টফিল্মে তিনি মাহমুদা নাম ব্যবহার না করে তানিশা খাঁন ব্যবহার করেছিলেন।
নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ নাগবাড়ি এলাকার ডায়াবেটিস হসপিটালের সিকিউরিট গার্ড বাবা আক্কাস ও মা সুফিয়া বেগম জানতেন না মেয়ে কখন কি করেন, কোথায় যান। তবে তাঁরা এটুকু জানতেন নগরীর উকিলপাড়া এলাকার ‘টপ টেন’ এর সেলস্-গার্ল হিসেবে চাকরি করেন তাঁদের মেয়ে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ঝারা নামে বছর ৭ একের একটি কন্যা রয়েছে মাহমুদা ওরফে তানিশা খাঁনের। এই মেয়ে জন্মের পরপরই স্বামীর সাথে বিচ্ছেদে চলে যায় সে। এরপরই থেকেই তাঁর জীবন যাপনে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে থাকে। কখনো কখনো বাড়িতে ফিরলেও অনেক সময় থাকতেন বাড়ির বাইরে।
পরিবার থেকে জানতে চাইলে উত্তর আসতো একটাই ‘শ্যূটিংয়ের কাজে বাইরে ছিলাম, বাইরে যাচ্ছি’ এর বাইরে তাঁর পরিবার আর কিছুই জানতেন না। তবে মাহমুদা ওরফে তানিশা খাঁনের অভিনয় করা উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। কেবল ‘মর্ডান মেয়ে’ নামে চার মিনিটির একটি শর্টফিল্ম এর সন্ধান পাওয়া যায়। সেও খুব বেশি দিন আগে এটি করা হয়েছে তাও নয়। ইউটিউবে এই ভিডিওটির সবেমাত্র ১৯ শ’ ভিউয়ার। এটি পরিচালনা করেছিলেন রাজু দেওয়ান নামে এক ব্যক্তি।
এদিকে স্থানীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, মেয়ে ঝারাকে রেখেই এদিক সেদিক চলে যেতেন তানিশা। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, হুল্লোড় করেই পার করে দিতেন অনেকটা সময়। দামি দামি রেস্টুরেন্ট ও শপিং মলে চলে যেতেন শপিং করার জন্য। সপ্তাহ হয়ে যেত কখনো কখনো বাড়ি ফিরেনি সে। বাবা মা এর জবাবে সদুত্তর পেতেন না।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. কামরুল ইসলাম বলেন, সে কার সাথে এই ফ্ল্যাটে ছিলো সে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আশপাশের কেউ কিংবা ওই নারীর পরিবার থেকেও এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো ধারণা দিতে পারেনি। তবে, ওই বাড়ির মালিক জানিয়েছেন তাঁরা স্বামী স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন।
ওসি আরও জানান, ধারণা করছি এই হত্যাকান্ডটি গত ২ থেকে তিন দিন আগে ঘটেছে। নারীটির গলায় ওড়না প্যাচিয়ে শ^াসরোধ করা হত্যা করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলে বিস্তারিত জানতে পারবো। আমরা এখন চেষ্টা করছি তাঁর সাথে কে থাকতেন তা জানার জন্য। ওই ব্যক্তির হদিস পেলে জানা যাবে এর আদ্যপান্ত।
তবে কামরুল ইসলাম মাহমুদার পরিবারের বরাত দিয়ে এটুকু নিশ্চিত করে বলেন, ‘তিনি (মাহমুদা) যাঁর সাথেই ওই ফ্ল্যাটে ছিলেন তিনি তাঁর স্বামী নন, এ ব্যাপারটি তাঁরই পরিবার নিশ্চিত করেছেন। কেননা, সে তাঁর স্বামী ও সন্তান রেখেই ওই বাড়িতে ১ মাস ২০ দিন আগে ওঠেছিলেন। ধারণা করছি লিভ টুগেদার করতেন তাঁরা।’
অপরদিকে মাহমুদার লাশ উদ্ধার হওয়ার পর বেশ কিছু ছবি গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে চলে আসে। এসব ছবিতে অনেকের সাথেই দেখা যায় মাহমুদাকে। কখনো দামি কোনো রেস্টুরেন্টে। কখনো নামি কোনো শপিং মল। কখনো বা খোলা কোনো উদ্যানে।
অনেকে বলছেন, এসব ছবির মানুষগুলোকে নজরদারিতে আনা গেলেই খুঁেজ পাওয়া যেতে পারে ওই ফ্ল্যাটটিতে কার সাথে সে লিভ-টুগেদার করেছিলেন? তাঁদের ধারণা, হয়তো এই মানুষগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ঘাতক।
মিডিয়া তথা নাটক, সিনেমা, মডেলিংয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিলো দেওভোগ নাগবাড়ি এলাকার আক্কাছ আলীর মেয়ে মাহমুদা। তাঁর জীবন যাপনও ছিলো অত্যন্ত উচ্চবিলাসী। আর এ কারণেই স্বামী ও কন্যা সন্তান রেখেই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেকের সাথে।
সর্বশেষ মাত্র ১ মাস ২০ দিন আগে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক ব্যক্তিকে (বয়ফ্রেন্ড) স্বামী পরিচয় দিয়ে সদর উপজেলার গোগনগর আলামিন নগর এলাকার মোহাম্মদ আলী আকবরের বাড়ির একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন মাহমুদা। তবে তাঁর সেই বয়ফ্রেন্ড কে ছিলো (?) তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
সোমবার (৩০ জুলাই) রাতে মাহমুদার ভাড়া নেয়া ফ্ল্যাটটি তালাবন্ধ ছিলো এবং এর ভেতর থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়ায় পুলিশে খবর দেয় তাঁর প্রতিবেশীরা। পুলিশ এসে মোহাম্মদ আলী আকবরের তিনতলা ভবনের নিচ তলার ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে উদ্ধার করে এক নারীর অর্ধগলিত লাশ। ততক্ষণ পর্যন্ত সবাই জানতেন না তাঁর পরিচয়।
প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, এই ফ্ল্যাট যাঁরা ভাড়া নিয়েছিলেন তাঁদের সাথে তেমন দেখা সাক্ষাত হতো না। কথাও হতো না। তাই তাঁরা কে কি করেন, নাম কি, সে কিছুই জানতে পারেনি। পুলিশও উদ্ধার করা লাশটি অজ্ঞাত হিসেবে ময়না তদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করেন।
এদিকে লাশ উদ্ধারের পর ওই নারীর জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে তাঁর পরিচয় শনাক্ত করা হয়। জানা গেছে সে দেওভোগের নাগবাড়ি এলাকার আক্কাছ আলীর মেয়ে মাহমুদ। মাহমুদা শহরের উকিলপাড়া এলাকার টপ টেনের একজন কর্মচারী। মাঝে মাঝে দু একটি শর্টফিল্মেও কাজ করেছিলেন বলে শোনা যায়।
জানা গেছে, মাহমুদার বাবা আক্কাছ আলী নাগবাড়ি এলাকার ডায়াবেটিস হাসপাতালে একজন সিকিউরিটি গার্ড। ব্যক্তিগত জীবনে মাহমুদা এক কন্যা সন্তানের জননী। ধারণা করা হচ্ছে কোনো রাজনীতিক কিংবা মিডিয়া সংশ্লিষ্ট কারো প্রলোভনে পড়ে মাহমুদা স্বামী সন্তান রেখে ওই ফ্ল্যাট বাড়িটি ভাড়া নিয়ে লিভ টুগেদার করতেন।
এদিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, উচ্চ বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত মাহমুদাকে প্রায় সময় রাজনৈতিক নেতাদের উপিস্থিতিতে বিভিন্ন সভায়ও দেখে গেছে। তবে সঠিক তদন্ত আর মাহমুদার কললিস্ট চেক করলেই এই হত্যার রহস্য যেমন উন্মোচিত হবে তেমনি জানা যেতে পারে তাঁর সাথে কে ছিলো ওই ফ্ল্যাটে এবং আরও কারা কারা আসতেন এখানে?
প্রসঙ্গত, সোমবার (৩০ জুলাই) রাতে সদর উপজেলার গোগনগর আলামিন নগর এলাকার মোহাম্মদ আলী আকবরের তিন তলার ভবনের নিচ তলার তালাবদ্ধ ফ্ল্যাট বাসা থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরের উকিলপাড়ার টপটেন নামক ফ্যাশন হাউজের সেলস গার্লস ও মডেল মাহমুদা (২৫) নামের এক তরুণীর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার পর থেকে নিহত মাহমুদার কথিত স্বামী নিখোঁজ রয়েছেন।