আজ শনিবার, ১লা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রূপগঞ্জের বাঙ্গাল বাড়িতে নতুন প্রজন্মের জন্য বাঙ্গালিয়ানার পুরনো ঐতিহ্য

বাঙ্গাল বাড়িতে

রূপগঞ্জের বাঙ্গাল বাড়িতে নতুন প্রজন্মের জন্য বাঙ্গালিয়ানার পুরনো ঐতিহ্য

বাঙ্গাল বাড়িতে
রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি ঃ বাংলা ভুখন্ডের প্রতিটি বাড়িই বাঙ্গাল বাড়ি। যেখানে বাঙ্গালীর বসবাস সেখানেই বাঙ্গাল বাড়ি। হোক তা ছন,গোলপাতা,তালপাতা কিংবা কলাপাতায় তৈরী করা ডেরা বা ঝুপড়ি ঘর কিংবা ইট পাথরের ও লোহার খাঁচায় বন্ধি বিলাসবহুল অট্টালিকা। সবাই নিজেকে বাঙ্গালীর আচ্ছাদনে ঢাকেন । তৃপ্তির ঢেকুড় তুলেন আমি বাঙ্গালী। আমার বাসও তাই বাঙ্গাল বাড়িতেই। একটু পেছন ফিরে দেখি। কৃষি নির্ভর এ বাঙ্গালী জাতির প্রধান পেশাই ছিল কৃষি। তাই কৃষি যেমন একদিকে জীবন জীবিকার হাতিয়ার। অন্যদিকে কৃষিপন্য,সামগ্রি নির্ভরই আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য। আর গ্রাম প্রধান বাংলাদেশের প্রধান পেশা কৃষি হিসেবে ঐতিহ্যের দিক বিচারে গ্রামীন পরিবেশই বাঙালীর ঐতিহ্য।

এই তো যেদিন আমরা বা আমাদের বাবা,দাদা কিংবা তার দাদা স্বগোষ্ঠীই বাঙ্গালী ছিলেন। তাদের হয়তো আধূনিকতার ছোঁয়ায় যান্ত্রিক অবয়ব ছিল না। যান্ত্রিক যাঁতাকলের ঘাণি তারা টেনে দেখেন নাই। তবে তারা সত্যিকারের ঘানি টেনেছেন। সরষে বিজ থেকে সরাসরি সরিষা তেল বের করেছেন। আবার মিষ্টি আখের গুড় তৈরীতে কায়িক শ্রম ব্যয় করেছেন। আখের রস বের করতে পালের বলদ,মহিষ তাড়িয়ে এনালগ যন্ত্রের চাকা ঘুরিয়েছেন শরীরের ঘাম ঝড়ানো শ্রমে। ক্ষেতে খামারে চাষাবাদ করেছেন একই কায়দায়। নিজেই ও তার পরিবারের লোকজনকে নিয়ে মাথায় বোঝা বহন করেছেন। এরআগে চাষাবাদের সময় ধান মারাই করতে মলনে ব্যবহার করেছেন বাঁশের তৈরী একধরনের মই। কাঠের ও লোহার তৈরী লাঙ্গল,নল বরাকের তৈরী মোটা বাঁশের জুয়াল। আবার পালের গরু মহিষের দ্বারা কাজের সময় অন্যের ফসলহানী ঠেকাতে মুখে কাপাই লাগানোর দৃশ্য। রোধের প্রখরতা ও বৃষ্টিভেজা থেকে বাঁচতে চাতাল বা পাতলা পড়তেন কৃষকরা।

আবার নদী মাতৃক এ বাংলার পথ ঘাট আজকের ন্যায় সড়ক প্রধান কল্পনাও করা যেত না। সেদিনকার পরিবেশ ও জনজীবনের ব্যস্ততাও নদী কেন্দ্রিক ছিল। প্রাচ্যের যত জনপদ যেমন নদী কেন্দ্রিক গড়ে ওঠেছে। তেমনি নদী মাতৃক বাঙ্গালীরা প্রথমে পালতোলা নৌকা,বৈঠা বাওয়া ডিঙ্গি নৌকা,তালের খোলের কোষা ও কলাগাছের বেরার সাথে পরিচয় ছিল। আবার বাণিজ্যকভাবে বৃহৎ পরিসরে মালামাল ও মানুষজনের সুবিধায় নৌ পরিবহনে গ্রামে গঞ্জে দেখা যেত গুনটানা নৌকা বা তরী। এসব গুনের মাঝিদের গান তো কালজুড়ানো ভুবনজয়ী বিখ্যাত নানা গীতিকার গেয়েছেন। সেই সময়ের মরমী কন্ঠশিল্পি আব্বাস উদ্দিনের কন্ঠে বাউয়াইয়া গান“নাইয়া রে নায়ের বাদাম তুইল্লা কোন দেশে যাস চইল্লা…” বেশ জনপ্রিয় ছিল।

আজো এসব গান সেসব ঐতিহ্যেও কথাই মনে করিয়ে দেয়। আবার সড়ক পথে পালকী, গরুর গাড়ী,মহিষের গাড়ী, গাধা ও ঘোড়ার গাড়ীর প্রচলনও ছিল বেশ। গায়ের আঁকা বাঁকা মেটোপথ বেয়ে সেই সময়ের অবগাহন আজ শুধুই স্মৃতি কারো কাছে রূপকথার নগরী আবার কারো কাছে দুঃসহ স্মৃতি। বাঙ্গালী কৃষকের পাশাপাশি বণিক শ্রেণির মাঝেও ছিল কিছু বাঙ্গালী রীতি নীতি। বৈশাখী হালখাতার জন্য তাদের সারা বছরের লেনাদেনা চুকে দেয়ার আয়োজন ছিল বেশ। আর বৈশাখকে ঘিওে গাছতলা,মুড়ি মুড়কী, পান্তা ইলিশ, শত সব্জি,ষাট সব্জি,সাত সব্জিসহ তেঁতো নিমপাতা গুলে খাওয়ার প্রাতপান রীতিও ছিল নানা স্মৃতি জড়িয়ে। চিকিৎসা চলতো টোটকা কায়দায়। এ পাড়ায় ও পাড়ায় কবিরাজ না হলেও একটু কিতাব পড়–য়ারাও ঝাড়ফুঁক করতেন। চলতো ভেষজ চিকিৎসা। লতাপাতা ঘষে কাটা গায়ের রক্ত বন্ধ করে দিত । সাপে কামড়ালে ওঝা ঝাড়তো বিশেষ গান করে। পাড়ায় পাড়ায় বাউল গানের আশর হতো। ক্ষেতে খামারে কাজ করা সাধারন শ্রমিকরাও ছয়ফর মুল্লুক, রহিম রুপবান ,গাজী কালু, হাতেম তাই, কমলার বনবাস,বেহুলা ইত্যাদি বিখ্যাত গল্পের পাট করতেন।

গ্রামের বাঙ্গালীরা পাড়া মহল্লায় বিশেষ অনুষ্ঠানে মঞ্চ নাটক করে তাদের অভিনয় দক্ষতা জাহির করতেন। শিক্ষা ব্যবস্থা কেবল মক্তব কেন্দ্রিক ছিল।মুসলিম প্রধান এ দেশের মসজিদের সংখ্যাই বেশি ছিল। তাই মসজিদের হুজুরের কাছে সকাল বেলা পবিত্র কুরআন পাঠ শিখে নিতেন । লেখা পড়া বলতে কায়দা আমপাড়া কিংবা কুরআন শরীফ পর্যন্ত যোগ্যতা ছিল গ্রামীন শিক্ষা দীক্ষার তালিকায়। তবে গ্রামের অনেকেই বিলেতে যেয়ে লেখা পড়া করতেন।

এক সময় অবহেলিত জনপদ হিসেবে বাঙ্গালীর পরিচয় হতো ব্রিটিশদের কাছে হতদরিদ্র হিসেবে। সময়ের তালে এখন হয়তো সেই পরিবেশ নেই। তবে পুরনো ভুলে যেমন কেউ এগুতে পারে না তেমনি বাঙ্গালী জাতিও তা ভুলেন না।

এতক্ষনে পুরুষতান্ত্রিক সামান্য ঐতিহ্যের বর্ণনায় ডুবে গেলেও গ্রামীণ নারীর মাঝেও ছিল বাঙ্গালভাব। তাদের গায়ে গত্ত্বরে ষোলআনাই বাঙ্গালী ভাব প্রকাশ পেত। লাজুক,মহিয়সী,পর্দানীসিন ও মমতাময়ী বিশেষণগুলো বোধহয় কেবল বাঙ্গালী নারীর বেলায় দেখা যেত। আবার সনাতনী নারীদের শালীনতা বজায়ে চালচলন, তাদের সামাজিক রীতি নীতি অতিশয় প্রশংসনীয় ছিল। তাদের ঘরের আসবাবগুলোর মাঝে অন্যতম ছিল ঘরের এক কোনে ফসল রাখার জন্য বাঁশের তৈরী গোলা। এ গোলায় রাখা হতো ধান,গম,ভুট্টা ইত্যাদি ফসল। বাঙ্গালী পরিচয়ের সাথে “গোলাভড়া ধান আর গোয়ালভরা গরু ” অন্যদিকে পুকুর ভরা মাছ” থাকায় মাছে ভাতে বাঙ্গালী কথাটি আজো লেগে আছে। তবে অনেকের বাড়িতেই এখন গোলা দেখা যায় না। গোলা থেকে ধান বা অন্য দানাদার খাদ্যদ্রব্যগুলো খাবার পক্রিয়ার কাছাকাছি আনতে অপর একটি মাটির বিশেষ পাত্র ব্যবহার করতেন নানী দাদীরা। এ পাত্রের নাম আজো আমরা ব্যবহার করি আমাদের প্রিয়জনের মধ্যে কেউ একটু শারীরিকভাবে মুটিয়ে গেছে বলে। মজা করেই পরিবারের ভাবী,বোন বা নিজের স্ত্রীকেও বলে ফেলি মটকি। হ্যাঁ বলছিলাম মটকির কথা। মাটির তৈরী এ পাত্রটি শুধু চাল রাখার জন্যই ব্যবহার হতো না। এ পাত্রটি আকারে বড় হওয়ায় গ্রামের দাতব্য প্রতিষ্ঠানে পানি সংরক্ষণ করে রাখার জন্য মাটিকে পুতে রেখে সরা দিয়ে ঢেকে দিত।

বাঙ্গালী নারীরা বাড়িতে মেহমান এলে পিঠা পুলি তৈরী করে খাওয়ানো হতে হরেক রকম স্ুস্বাদু খাবার। এ পিঠা তৈরীর জন্য গুড়ি ও সুজি কিংভা ধান থেকে চাল, চাল থেকে গুড়ি, আবার গম থেকে ছাতু, ডাল থেকে বেশন ইত্যাতি তৈরীতে ঢেঁকির ব্যবহার দেখা যেত। দেখা যেত কাইল –ছাট,চালনি,কুলা,ডুলা ইত্যাদি।

অন্যদিকে এখন অনেক বাড়ির সীমানায় কাটা তারের বের দিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেন। আগে বাড়ির সীমানায় মান্দার গাছ,বেতগাছ,কাটাযুক্ত আঁইক্কা,বন বাঁশ লাগানো হতো। এতে প্রাকৃতিকভাবে বেষ্টনী তৈরী হতো। অপকৌশল প্রয়োগকারীরা ইচ্ছে হলেই আর প্রবেশ করতে পারতো না। মাটির তৈরী বিশেষ দেয়াল ঘরগুলোর কিছুটা আজো কোথাও কোথাও দেখা যায়। তবে বেশ পুরনো পদ্ধতির এ মাটির ঘরগুলোকে বলা হতো প্রাকৃতিক বায়ু শীতলীকরণ(এসি)।

সবকিছুর মাঝে কিছু বিরম্বনাও ছিল। ছিল অনেক কিছুই কিন্তু আজ তো নেই। এই নেই নেই পরিবেশের মাঝে এক দেশ প্রেমিক লেখক ও কলামিষ্ট মীর আব্দুল আলীম একটি বাঙ্গাল বাড়ির স্বপ্ন আঁকলেন। তার মালিকানাধীন পূর্বাচলের ৯নং সেক্টরের একটি প্লটেই শুরু করলেন বাঙ্গাল বাড়ির স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ। তার ভক্তানুরাগী ও সহকর্মীদের কাছে প্রথমে স্বাভাবিক সবুজ আকৃষ্ট এ লেখক স্বভাব সুলভ বৃক্ষরোপনের কাজ হাতে নিলেন। তার বাঙ্গাল বাড়ি থেকেই শুরু করলেন এ অগ্রযাত্রা। তাঁর মামা লায়ণ মোজাসে বাংলাদেশের গ্যাজেটভুক্ত সমাজসেবক। একজন সাদা মনের মানুষ হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় স্বীকৃতি। তার ভাগনে মীর আব্দুল আলীম। দেশের স্বনামধন্য জাতীয় দৈনিক ও আন্তর্জাতিক জার্নালেও নিয়মিত কলাম লেখক হিসেবে রয়েছে তার খ্যাতি। বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে একজন শিল্পপতি হয়েও নিজের জন্মস্থানকে সুন্দর রূপে কল্পনা করেন। তাই স্থানীয় দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে পড়েন। স্থানীয় সাংবাদিকদের অনুরোধে রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।আর এ ক্লাবের সতীর্থদের সহযোগীতনা নিয়ে তার বাঙ্গাল বাড়িতে পুরনো ঐতিহ্য রক্ষায় সংগ্রহশালা গড়ে তুলছেন। এ সংগ্রহশালায় বাঙ্গাল বাড়ির সেই স্মৃতিময় চিরচেনা রূপ হয়তো দিতে পারবেন না তবে যাদুঘরের ন্যায় কিছু বস্তুু সংরক্ষন করে রাখা হচ্ছে। এক সময় নির্মাণাধীন পূর্বাচল উপশহর এলাকায় এ বাঙ্গাল বাড়িকে অনুসস্বরন করবে অন্যরা। যা দেখে আজকের প্রজন্মের যে কেউ একবার হলেও বলবেন পেলেন কই সব ? কি নেই বাঙ্গাল বাড়িতে?

ছনের দুটি ডেরা আছে;ডেরার পাশে বাঁশ ঝাড়স দেবদাড়– আর কলাবাগে নানা ফুলের বাহার। বাবুই পাখির বাসা আছে ; মাটির কলসে জল টিউবওয়েলের ডান্ডা আছে; আছে করমজা ফল। এলে কেউ বসতে দেবে পীড়ি,হানকীতে খেতে হবে, পুুদিনা পাতার চা হবে ;হুক্কা টানলে তাও রবে। ঝাউ খিচুরীর আড্ডা হবে;পিঠা পুলির মেলা হবে বাউল গানের আশর হবে;দেশী জাতের পসরা হবে ঐতিহ্যের ষোলআনাই বাঙ্গাল বাড়ির ঘরে।

এসব বিষয়ে কথা হয় বাঙ্গাল বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা কলামিষ্ট মীর আব্দুল আলীমের সঙ্গে, তিনি জানান, আমরা বৈশাখ এলেই একদিনের জন্য বাঙ্গালী সাজি। সারা বছর ভিনদেশী নানা সংস্কৃতি চর্চা করে অনেকে যা দুঃখজনক। আমরা একে একে বাঙ্গালীর পরিচয় গুলোকে আগামী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিলেই রক্ষা হবে আমাদের ইতিহাস , ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকালচার। তাই সকলেরই উচিৎ বাড়ির পুরনো কোন আসবাব যা কালের স্বাক্ষী তা ধ্বংসা না করা। বরং যে কোন পদ্ধতিতে সংরক্ষন করা উচিৎ। এ সময় তিনি নতুর প্রজন্মকে বাঙ্গাল বাড়ি ঘুরে দেখার আমন্ত্রণ জানান তিনি।