আজ মঙ্গলবার, ২১শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সোনারগাঁ জাদুঘরে বিলুপ্ত প্রায় ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি পুতুল নাচ

ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি পুতুল নাচ

সোনারগাঁ জাদুঘরে বিলুপ্ত প্রায় ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি পুতুল নাচঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি পুতুল নাচ

মাজহারুল ইসলামঃ হেলায় সুযোগ হারাবেন না। চলে আসুন আমাদের প্যান্ডেলে। এক্ষনি শুরু হতে যাচ্ছে সোনারগাঁয়ের ঐতিহ্যবাহী হাসিখুশি পুতুলনাচ। পুতুলনাচ দেখে আনন্দচিত্রে বাড়ি ফিরে যান।

সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের মাসব্যাপী লোকজ মেলায় ভেসে আসা আঁওয়াজের সুত্রধরে সামনে যেতেই দেখা গেলো বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচ। নিউ সোনারগাঁও হাসিখুশি পুতুলনাচ। টিকেট কাউন্টারে মলিন মুখে বসে আছে মিলন মিয়া। সাড়া কেমন জানতে চাইলে মিলন মিয়া জানান, একেবারেই খারাপ অবস্থা। এখন আর পুতুলনাচে আগের মতো লোক সমাগম নেই। আমরা খুব কষ্টে আছি। ভাড়ার কথা জানতে চাইলে জানান, ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক রবিউল ইসলামের সহযোগিতায় ষ্টেজের জায়গা ফ্রি পেয়েছি। দেখে মনে হলো মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সেই চরিত্রগুলোই ফুটে ওঠেছে পুতুল নাচের বর্তমান প্রেক্ষাপটে। সমাজের সংস্কার, প্রেক্ষিত-প্রাসঙ্গিকতা, দায়িত্ববোধ আর বিভ্রমের বেড়াঝালে থমকে থাকা যে জীবন, তারই বিশ্বস্ত রূপায়ণ পুতুলনাচের ইতিকথা।

যেখানে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার হয়না, অনেক কষ্টসাধ্য সেখানে বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী  পুতুল নাচকে আধুনিক রূপ দিবো কিভাবে? বলছিলেন নিউ সোনারগাঁও হাসিখুশি পুতুল নাচের মালিক মিলন মিয়া। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও পৌরসভার অনন্তমুছা গ্রামের মৃত শাহাবুদ্দিনের ছেলে মিলন মিয়া প্রায় ২০ বছর যাবত দি নিউ সোনারগাঁও হাসিখুশি পুতুলনাচ নামেই বিভিন্ন মেলায় ও নানা অনুষ্ঠানে পুতুল নৃত্য পরিবেশন করে আসছেন। হাসিখুশি পুতুল নাচের সাথে কাজ করছেন ৩৫ বছরের অভিজ্ঞ ও  শিল্পকলার সনদপ্রাপ্ত পুতুল মাস্টার ও যাদুশিল্পী আবুল হোসেন , শিল্পকলার সনদপ্রাপ্ত যাত্রাশিল্পী ৪৭ বছরের অভিজ্ঞ বরিশাল ভোলার আমির হোসেন।

আমির হোসেন বর্তমানে অর্গান বাজিয়ে পুতুলের সাথে কন্ঠ দেন। তার কৌতুক প্রিয় কথার মাধ্যমে সবাইকে আনন্দিত করেন। সাথে আছেন নরসিংদী ভেলানগরের বিখ্যাত ড্রাম মাস্টার বাদশা আলম। সারা দেশের এই মৃতপ্রায় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার কোন বাস্তব পদক্ষেপ নেই বলে জানিয়েছেন পুতুল নাচ শিল্পীরা। শিল্পকলা একাডেমী, বাংলা একাডেমী, ঢাবি ও জাবি নাট্যকলা বিভাগ দীর্ঘদিন যাবত এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করলেও মাঠ পর্যায়ের শিল্পীরা আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ায় দিনদিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে পুতুল নাচ। অথচ একসময় মৌর্যদের তত্বাবধানে পুতুলনাচের চর্চা, ভারত নাট্যশাস্ত্রে পুতুল নাচের উপস্থিতি, জয়দেবের গীতগোবিন্দে পুতুল নাচের সংশ্লিষ্টতা, চৈতন্যদেবের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সাথে পুতুলনাচের সম্পৃক্ততা এ সবই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা উচ্চবিত্তের সক্রিয় ও ইতিবাচক পৃষ্ঠপোষকতার (ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক) চিত্র তুলে ধরে। পুতুলনাচের দলগুলোকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় না আনা এবং শিল্পী কলাকুশলিদের উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রদর্শনের ব্যবস্থা না করা হলে পুতুলনাচ বিলীন হয়ে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

পুতুল নাচের মাধ্যমে সমাজের নানা অসঙ্গতি, রূপকাহিনী, কল্পকথা, ধর্ম ও ইতিহাস তুলে ধরা হয়। যেমন রাম-সীতা, মনসা, বেহুলা , বেদের মেয়ে, রূপবান, নিমাই সন্যাস, হরিণ শিকার, বাঘ শিকার, নৌকাবাইচ, ভূতের খেলা, সাপ খেলা , মুক্তিযুদ্ধ, অল্প বয়সে বিয়ে, যৌতুক, অশিক্ষা প্রভৃতি। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথায় সমাজ, মানুষ, মানুষের বিচিত্র প্রবণতা, প্রবৃত্তির নানান অনুষঙ্গ, জীবনের সঙ্কট, প্রেম-অনুভূতি , প্রকৃতি ও নির্মমতা এবং নিয়তির অমোঘতা চিত্রিত হয়েছে লেখকের ব্যক্তিগত অভিব্যক্তির অন্তরালে।