আজ শনিবার, ২৫শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

স্কুল শুরু শেষে লাঠি হাতে শিক্ষকদের প্রহরায় শিক্ষার্থীদের সিঁড়ি বেয়ে উঠা

নিজস্ব প্রতিনিধি:‘হৈ হুল্লোড় করে দল বেধে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে ক্লাসে যাওয়া প্রতিযোগিতা করছিল শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে কয়েকজন দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠেও যায়। কিন্তু এর মধ্যে উচ্চ সরে শিক্ষিকা রতœা রায় বলতে শুরু করলেন, ‘যে দৌড় দিবে তাকে ধরে মারবো। লাইন ধরে একজন একজন করে যাও।’ কে শুনে কার কথা লাঠি নিয়ে আসতে না আসতেই দৌড়ে ১০ থেকে ১২ জন উঠে গেলো। হতাশ কণ্ঠে রতœা রায় নিউজ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ‘এগুলোকে নিয়ে আর পারি না। কোন দিন কোন দুর্ঘটনা ঘটবে তখন সকলের টনক নড়বে। তার আগে কেউ এগিয়ে আসবে না।’

৩১ অক্টোবর মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকার ২৭ ও ২৬নং লক্ষ্মী নারায়ণ বালক বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় এ দৃশ্য।

শিক্ষিকা রত্মা রায় নিউজ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ‘প্রতিদিনই স্কুল শুরু ও ছুটির সময় লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যাতে করে শিক্ষার্থীরা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা না করতে পারে। সিঁড়ি যতটা সরু ততটাই ঝুঁকিপূর্ণ। সিঁড়ি কোঠায় ফাটল আছে। এমনিতেই স্কুলের বিভিন্ন রুমে ফাটল দেখে অভিভাবকেরা ভয়ে থাকে। তার উপর নতুন করে কোন ঘটনা ঘটলে শেষে স্কুল বন্ধ করে দিতে হবে।’

তিনি নিউজ নারায়ণগঞ্জকে আরো বলেন, ‘২০১৫ সালে ভূমিকম্পে স্কুলের দুই রুম ও কয়েকটি পিলারে ফাটল দেখা দেয় যার মধ্যে একটি রুমের পিলার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পরবর্তীতে আবার ২০১৬ সালের ভূমিকম্পে ওই দুইটি রুমের পাশাপাশি শিক্ষকদের রুম, সিঁড়ি সহ বিভিন্ন জায়গায় নতুন করে ফাটল দেখা দিয়েছে। এসব করণে ভয় হয়। তাই ওদের দৌড়াদৌড়ি করতে না করি।’

স্কুল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ‘১৯৩৭ সালে ৪ শতাংশ জায়গার উপর স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। লক্ষ্মী নারায়ণ জিউর আখড়ার পাশে হওয়ায় এর নাম করণ করা হয় লক্ষ্মীনারায়ণ বালক বালিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে ১৯৭৩ সালের স্কুলটি জাতীয়করণ করা হয়। বর্তমানে স্কুলটিতে দুই সিফটে (সকাল ও দুপুর) শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৭৯০ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। শিক্ষক শিক্ষিকা রয়েছে ১৪ জন। এছাড়াও ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ১৪ জন জিপিএ-৫ সহ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ভিত্তিতে মেধা কোটায় প্রাথমিক বৃত্তি পেয়েছে ৩ জন।

সকাল শিফটের ২৭নং লক্ষ্মী নারায়ণ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নুরুন্নাহার নিউজ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ‘দুই তলা ভবনের ৭টি রুম আছে। যার মধ্যে একটি শিক্ষক শিক্ষিকাদের বসার জন্য আর বাকি ৬টি শিক্ষার্থীদের শ্রেনির কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। কিন্তু ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ও ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ এর দুইটি ভূমিকম্পে বিপদজনকভাবে ফাটল দেখা দেয়। পরবর্তীতে এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে অবহিত করলে তারা উপজেলা প্রকৌশলীর মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে বিপদজনক দুইটি রুমে শ্রেনির কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে তালা দিয়ে দেয়। যার ফলে এখনও ৪টি রুমে শ্রেনির কার্যক্রম চলছে।’

দ্বিতীয় শ্রেণী ছাত্রী জয়ীতা ঘোষের মা মনিকা ঘোষ নিউজ নারায়ণগঞ্জকে আরো বলেন, ‘ সিঁড়িগুলো সরু উঠতে গেলে প্রায় সময় বাচ্চারা পরে গিয়ে ব্যথা পায়।’

২৬নং লক্ষ্মী নারায়ণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান তাপসী সাহা নিউজ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ‘স্কুলের মেরামতের জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিস ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র বরাবরে লিখিত আবেদন করা হয়েছে। তবে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ নেয়নি। আর উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে প্রকৌশলী এনে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ দুই রুম বন্ধ করে দিয়ে গেছে। বিগত দুই তিন বছর ধরে এ ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবনেই চলছে পাঠদান।’

২৬নং লক্ষ্মী নারায়ণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নাজমুল আলম সজল নিউজ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ‘স্কুলটি নিয়ে আমরাও চিন্তায় আছি। যে কোন সময় যে কোন ঘটনা ঘটতে পারে। একটি স্কুলের উন্নয়নের জন্য তিন থেকে সাড়ে তিন শতাংশ জায়গা প্রয়োজন হয়। সেখানে আমাদের স্কুলটি সোয়া দুই শতাংশ জায়গার মধ্যে আছে। আর বাকি জায়গা স্থানীয় ভূমিদস্যুরা দখল করে রেখেছে। এ বিষয়ে স্থানীয় ভাবে মিমাংসা করতে গেলে ভূমিদস্যুরা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নিষ্পত্তি না হলে আমরাও কোন অনুদান পাচ্ছি না।’

তিনি আরো বলেন, ‘মামলা সংক্রান্ত জটিলতা নিষ্পত্তির জন্য সরকারে সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারি সহযোগিতা না পেলে এ ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে জায়গা উদ্ধার করা সম্ভব না। তাছাড়া বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের জন্য নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমানের কাছে আবেদন করেছি। তবে তিনিও বলেছেন মামলা নিষ্পত্তি হলে সহযোগিতা করবেন।’

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের সহকারী শিক্ষা অফিসার সামিনা নার্গিস বলেন,‘স্কুলটির তদন্ত রিপোর্ট আমরা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। একই সঙ্গে স্কুলের মেরামত করার জন্যও আবেদন করেছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে তেমন কোন কিছুই জানায়নি।’