সংবাদচর্চা রিপোর্ট
নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানসহ প্রতিটি মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে রাষ্ট্রের। যদিও এসব অধিকারের বেশিরভাগই অধরা রয়ে গেছে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের (প্রতিবন্ধী) ক্ষেত্রে। তাদের প্রাপ্য অধিকারগুলো বাস্তবায়ন হয় না কখনোই। প্রতিটি পদক্ষেপে তারা থাকছেন উপেক্ষিত এবং অনুপস্থিত।
প্রতিবছরই জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দের আয়তন বাড়ছে। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন এবং অধিকারের জায়গা থেকে যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার, সেখানে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
নগরীর উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বর্ধনের লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন এর উদ্যোগে নগরীর বিভিন্ন স্থানে নগরবাসীর চলাচলের সুবিধার্থে শহরের ফুটপাতগুলোকে রং-বেরং এর টাইল এর মাধ্যমে সংস্কার করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের এই সংস্কারে উদ্যোগে পাল্টে যাচ্ছে শহরের চেনা মুখ এবং অপরদিকে নগরীর সৌন্দর্য ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বরাবরের মতো এ সকলের উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যাক্তিরা। নারায়ণগঞ্জের সড়ক কিংবা মার্কেট, যানবাহন সহ ইত্যাদি সেক্টর গুলোতে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য উপযোগী করে গড়া হয়নি। এরই মধ্যে শহরের বেশ কিছু ফুটপাতের সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং কিছু কাজ এখনো চলমান রয়েছে। চলমান এ সকল কর্মযজ্ঞে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের বিষয়টি মথায় রেখে কাজগুলো সম্পাদন করার দাবি জানিয়েছেন অনেকে।
অপর দিকে রাজধানী ঢাকাজুড়ে চলছে ফুটপাত সংস্কার ও নতুন টাইলস্ বসানোর কাজ। ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে বেশ কয়েকটি সড়কের ফুটপাত সংস্কার কাজ। তবে নতুন লাগানো এসব টাইলসে একটি নতুনত্ব সবারই চোখে পড়েছে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের (প্রতিবন্ধীদের) চলাচলের সুবিধায় ফুটপাতে বসানো হয়েছে ভিন্ন রং ও নকশার টাইলস্। যেগুলোয় হুইলচেয়ার ব্যবহার করে চলাচল করা যাবে সহজেই। আবার দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরাও সহজে ফুটপাত ঠাহর করে চলতে পারবেন।
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ফুটপাতে নতুন করে বসানো লাল-হলুদ টাইলসে মাঝের সারিতে রয়েছে ভিন্ন ধরনের টাইলস্। হলুদ রঙের এসব টাইলসের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি লম্বা উঁচু দাগ। কিছু কিছুতে রয়েছে গোল গোল উঁচু দাগ।
বিভিন্ন ধরনের বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের (প্রতিবন্ধী) নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, কেবলমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থা প্রতিবন্ধী বান্ধব নয় বলেই মানুষের প্রাপ্য মৌলিক অধিকারগুলো থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের লঞ্চ স্টেশন, বাস টার্মিনাল, ট্রেন-স্টেশন, এমনকি এসব যানবাহনও প্রতিবন্ধীদের কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়নি। গণপরিবহনে তাদের ওঠানামার সুযোগ নেই। নারায়ণগঞ্জ শহরের সড়ক গুলোতেও প্রতিবন্ধীরা চলাচল করতে পারে না, ফুটপাত গুলোও তাদের জন্য সহায়ক নয়।
প্রতিবন্ধীদের চলাচলের পরিবেশও সৃষ্টি করা হয়নি কোথাও। আর কেবলমাত্র যাতায়াতের এই অসুবিধার জন্য অনেক শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ ‘বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (প্রতিবন্ধী) ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ তে বলা হয়েছে- ‘জন সাধারণের জন্য প্রাপ্য সব সুবিধা ও সেবাগুলো অন্যদের মতো প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমসুযোগ ও সমআচরণ প্রাপ্তির অধিকার বুঝায়।’ আইনে আরও বলা হয়েছে, ‘সর্বসাধারণ গমন করে এরূপ বিদ্যমান সকল গণস্থাপনা, এই আইন কার্যকর হবার পর, যথাশীঘ্র ও যতদূর সম্ভব, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (প্রতিবন্ধী) ব্যক্তিদের আরোহণ, চলাচল ও ব্যবহার উপযোগী করতে হবে।’
নগরীর বিশিষ্টজনরা মনে করেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্নরা (প্রতিবন্ধী) এ সমাজেরই অংশ। মানুষের শরীরে যেমন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ রয়েছে হাত, পা, মাথা, চোখ, নাক, মুখ তেমনি এ দেশের একটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ হচ্ছে প্রতিবন্ধীরা। মানুষের শরীরের কোন একটি অঙ্গ ছাড়া যেমন মানুষ চলতে পারে না ঠিক তেমনিভাবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তি তথা প্রতিবন্ধীদের ছাড়া দেশ চলতে পারবে না। তাদেরকে সাথে নিয়েই পথ চলতে হবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
একাধিক সচেতন নাগরিকরা আশা ব্যক্ত করে বলেন, মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর বলিষ্ট নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন আওয়তাভূক্ত প্রত্যেক এলাকাগুলোতে নজিরবিহীন উন্নয়ন স্বাধিত হচ্ছে। এ সকল উন্নয়নের সুফল যাতে প্রত্যেক শ্রেণির মানুষ ভোগ করতে পারে সেই দিকে নজর দেওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। নারায়ণগঞ্জে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের (প্রতিবন্ধি) সংখ্যা নেহাত কম নয়। এমনিতেই তারা সমাজের অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং অপেক্ষিত। বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পরিবারগুলো বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন সন্তানদের কোথাও একা ছাড়তে নারাজ। অপর দিকে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড গুলো বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের (প্রতিবন্ধি) সহায়ক হিসেবে গড়ে না তোলার কারনেও পরিবারগুলো বিপাকে রয়েছে।
জাতীয় বধির সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এড: তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (প্রতিবন্ধি) মানুষদের সাথে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন বৈশম্য করেছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিন সিটি কর্পোরেশন জনগনের ফুটপাতে হাটার ব্যবস্থা করেছে সেখানে সাধারণ টাইল্সের সাথে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের (প্রতিবন্ধি) জন্য বিশেষ টাইলস সংযোজন করা হয়েছে যা নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন করেনি। এছাড়া প্রতিবন্ধিদের উন্নয়নের জন্য আমরা একাধিকবার নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন কে চিঠি দিয়েছি কিন্তু তারা আমাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি এবং কোন কাজের অংশগ্রহন করার জন্যও বলেনি।
তৈমূর আলম খন্দকার আরও বলেন, প্রতিবন্ধিদের জন্য সরকারি জায়গার বরাদ্দ রয়েছে কিন্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন সেই জায়গা আটকে রেখেছে। প্রতিবন্ধিদের জায়গা রক্ষা করতে আমরা দ্রুত হাই কোর্টে মামলা দায়ের করবো।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মঈনুল হক দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন গুলোতে এ সকল কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে তবে আমাদের কাজ ১ বছর আগে করার কারনে বর্তমানে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের (প্রতিবন্ধি) জন্য টাইলস লাগানো সম্ভব হয়নি। পরবর্তিতে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যাক্তিদের জন্য আমাদের এ সকল কাজের পরিকল্পনা রয়েছে এবং উন্নত বিশ্বের ন্যায় আমরা নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করার উদ্যাগ গ্রহন করবো। আর যে সকল বধির সংগঠন গুলো রয়েছে তারা মেয়রের সাথে আলোচনা করে পাশে থাকতে পারেন বলে তিনি মন্তব্য করেন তিনি।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা এহেতেশামুল হক বলেন, নগরের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন স্থানে টাইল্সের ব্যবহার করা হয়েছে তবে ভবিষ্যতে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যাক্তি নজরে রেখে আমরা পরিকল্পনা করবো যাতে করে কোন নাগরিক সুযোগ থেকে কেউ বঞ্চিত না হয়।