নিজস্ব প্রতিবেদক:
মেঘনা উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে সমবায় সমিতির নামে গড়ে উঠা মিল্ক ভিটার রায়পুর দুগ্ধ কারখানা এখন বন্ধ হওয়ার পথে। সম্প্রতি গৃহিত হওয়া সোয়া ১৮ কোটি টাকার রায়পুর মহিষ উন্নয়ন প্রকল্পটি অনিয়ম অব্যবস্থাপনায় শুন্য অর্জনেই মেয়াদ উত্তির্ন হয়ে ভেস্তে যাওয়ায় এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ খামারিদের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহিত প্রকল্পে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও নীতিমালা অনুয়ায়ী প্রত্যাশা পূরণ হয়নি মোটেও।
এতে করে স্থানীয় ৫ শতাধিক সমবায়ী খামারীদের আশায় গুড়েবালি। এসব খামারীদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শুন্য অর্জনের কথা স্বীকার করে প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানান।
জানা যায়, ২০০২ সালে বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড (মিল্ক ভিটা) প্রতিষ্ঠা করে রায়পুর দুগ্ধ কারখানা। লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের মিতালী বাজারে ৫ একর খাস জমির উপর (ইজারাকৃত) এ কারখানা স্থাপন করা হয়। শুরুতে ২০-৩০ জন করে খামারীর সমন্বয়ে গঠন করা হয় একেকটি সমবায় সমিতি। এরকম প্রায় ৪০ টি ক্ষুদ্র সমবায় সমিতির মাধ্যমে খামারীদের থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। এসব খামারীরা প্রতিদিন নিজস্ব খামারে উৎপাদিত গরু ও মহিষের দুধ শর্ত সাপেক্ষে নির্ধারিত স্বল্প মুল্যে সরবরাহ করে আসছিল এ কারখানায়। প্রতিদিন একেকটি সমিতি ৪শ থেকে ৫শ’ কেজি দুধ সরবরাহ করতো।
ওই সময়ে মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ লাভবান হলেও লাভের মুখ দেখেনি খামারীরা। তবে বিশেষ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে খামারীদের ভাগ্য উন্নয়নের আশান্বিত করে কর্তৃপক্ষ।
অবশেষে দুধ ও মাংসের পাশাপাশি খামারীদের ভাগ্য উন্নয়নের সেই আশান্বিত প্রকল্পটি রায়পুর মহিষ উন্নয়ন ও কৃত্রিম প্রজনন প্রকল্প নামে অনুমোদন লাভ করে। সরকারি ৭৫ ভাগ ও মিল্ক ভিটা সমবায়ীদের ২৫ ভাগ অর্থায়নে মোট ১৮ কোটি ২৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ব্যায় ধরা হয় প্রকল্পে। ২০১৩ সাল থেকে প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। বর্তমানে ওই প্রকল্পের মেয়াদ উত্তির্ন হওয়ার ১ বছর পেরিয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে হঠাৎ ২০১৮ এর ডিসেম্বরে কারখানাটিতে দুধ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় কর্র্তৃপক্ষ। এতে করে ৫ হাজার লিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন দুগ্ধ শীতলী করণ মেশিন অকার্যকর অবস্থায় বিকল হওয়ার পথে রয়েছে। আর খামারীরা পড়েছেন বিপাকে।
এরিমধ্যে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত থেকে উন্নত মুররাহ্ জাতের ২০০ টি গাভী, ২০০টি বাছুর ও ১০টি ষাঁড় মহিষ ক্রয় করে কর্তপক্ষ।
ক্রয়কৃত এসব মহিষের বেশীর ভাগ (গাভী ও বাছুর) স্থানীয় ক্ষুদ্র সমবায়ী খামারীদের মাঝে ভুর্তুকি মুল্যে বিতরণ করা ও ষাড় মাহিষ থেকে সংগৃহিত বীজ (সীমেন)খামারীদের দেশীয় প্রজাতির মহিষে সরবরাহ করার কথা ছিল। যা করা হলে দেশীয় প্রজাতির সাধারণ মহিষ থেকে যেখানে পাওয়া যেত আড়াই থেকে ৩ কেজি দুধ আর প্রজনন উন্নয়নের পর ওই জাতের মহিষ থেকে পাওয়া যেত ০৮ থেকে ১০ কেজি দুধ। দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য বাস্তবায়ন, উন্নত খামার প্রতিষ্ঠায় প্রশিক্ষিত খামারীরা বেশী লাভবান হয়ে আগ্রহী হয়ে উঠতো।
এদিকে প্রকল্পের আওতায় খামারীদের সেবা দেওয়ার নিমিত্তে ওই কেন্দ্রে ৫টি শেড, একটি বীজাগার মেশিন, একটি গবেষনাগার, প্রজনন মেশিন, আধুনিক নিক্তিসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। সেখানে স্থাপিত ৫টি শেডে ১০০ টি গাভী, ৬০টি বাছুর ও ৫টি ষাঁড় মহিষের দেখা যায়।
অফিস কর্মকর্তারা খামারীদের এসব মহিষ না দিয়ে নিজেরাই ভিন্ন এলাকার রাখাল নিয়োগ দিয়ে তদারকি করছেন। আর এখানকার উৎপাদিত প্রতিদিনের ১০০ -থেকে ১৫০ লিটার মহিষের দুধ বাইরে বিক্রি করে দেওয়াসহ খাদ্য ক্রয়ে অনিয়ম করছেন বলে অভিযোগ উঠে। অনিয়ম অব্যবস্থাপনায় বর্তমানে ব্যাপক সুবিধা সম্বলিত সম্ভাবনাময়ী এই প্রকল্পটি খামারীদের কোন কাজেই আসেনি। এতে করে সমবায় সমিতির ৫ শতাধিক সদস্য চরম ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
খাস মহল চর রুহিতা, মিতালী বাজার, চরবংশী, মোল্লার হাট মিয়ার বাজার সমবায় সমিতির বেশ কয়েকজন সদস্য অভিযোগ করে বলেন, মিল্ক ভিটা আমাদের আশা দিয়ে এখন তারা দুধ সংগ্রহ বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের উন্নত জাতের মহিষ দেওয়ার কথা বলে প্রতারণা করেছে। মহিষ উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ও সমবায়ীদের নাম দিয়ে সরকারি অর্থ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে মিল্ক ভিটার কতিপয় অসাধু ব্যাক্তি। আমরা সমবায়ী কৃষকরা মাঠে মারা যাওয়ার মতো অবস্থা।
জানতে চাইলে রায়পুর দুগ্ধ কারখানার ব্যবস্থাপক ডা. ফরহাদুল আলম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের অর্জন শুন্য। তবে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দুধ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে এখানে উৎপাদিত দুধ গুলো বাইরে বিক্রি করা হচ্ছে। তাছাড়া যে সংখ্যক মহিষ আনার কথা তা না আনার কারণ জানতে চাইলে অন্য একটি উপকেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে বলে দাবী করেন এ কর্মকর্তা।
প্রকল্প পরিচালক প্রিতম কুমার দাস প্রকল্পের মেয়াদ উত্তির্ন হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, খামারীদের মাঝে ঋণ বকেয়া থাকায় প্রকল্পটি চালু করা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিক তদারকী থাকলে মহিষ উন্নয়ন ও প্রজনন প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটতো বলে মনে করছেন সচেতন মহল।