গাইবান্ধা প্রতিনিধি:
রমজানের আগেই অপরিহার্য হচ্ছে মুড়ি। ইফতারের আইটেমে যতো উপাদনই থাকুক সাদা ফুরফুরে মচ মচে সুস্বাদু এই মুড়ি ছাড়া অতৃপ্তি থেকে যায় রোজাদারদের। এছাড়া গ্রামবাংলার ঐহিত্যবাহী নাস্তা এবং অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম উপাদান হিসেবে মুড়ির প্রচলন এদেশে প্রাচীনকাল থেকেই। তবে সে মুড়ি হালের মেশিনে বানানো ক্ষতিকর ক্যামিকেল মিশ্রিত এবং বিস্বাদ মুড়ি নয়। মুড়ির কারিগরদের মাটির খোলায় লবণ পানি মেশানো চাল দিয়ে গরম বালুতে ভাজা হাতে তৈরি মুড়ি। আসন্ন রমজানকে ঘিরেই মুড়ির অতিরিক্ত চাহিদা পূরণে তৎপর হয়ে উঠেছে এ জেলার মুড়ির কারিগররা।
গাইবান্ধা জেলা শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাট-বাজার সমূহে মুড়ির প্রধান যোগানদাতা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের জগৎরায় গোপালপুরের বৈরাগীপাড়ার মুড়ির কারিগররা। দেশীয় মুড়ি সরবরাহের ব্যাপকতা কারণেই এই গ্রামটিকে এখন সবাই ‘মুড়ির গ্রাম’ হিসেবেই চেনে। কেননা, মুড়ি যাদের জীবন-জীবিকার উৎস, সেই মুড়িওয়ালা নামের মুড়ি তৈরির অখ্যাত কারিগরদের এই গ্রামে কারবার ও বসবাস।
গাইবান্ধা শহর থেকে ৫ কি.মি. দূরে বালুয়া-নাকাইহাট-গোবিন্দগঞ্জ সড়কে সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের জগৎরায় গোপালপুরের বৈরাগীপাড়া গ্রাম। এই গ্রামে মুসলমান, হিন্দু ও বৈষ্টমি সম্প্রদায়ের ১শ’ ৫০টি পরিবার প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ বছর যাবৎ চাল থেকে মুড়ি ভেজে তা বাজারে বিক্রি করে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে। এই মুড়িই তাদের পেশা এবং জীবন জীবিকার একমাত্র উৎস। প্রথমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শুধু হিন্দু ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের লোকজনই পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে বংশপরম্পরায় এই মুড়ির কারবারে জড়িত ছিল। সে কারণে এই গ্রামটির নামও হয়েছে বৈরাগীপাড়া। কেননা বৈষ্ণবদেরই প্রচলতি ভাষায় বৈরাগী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক পরিবার ভারতে আশ্রয় নিয়ে আর ফিরে আসেনি। সেই থেকে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজনও এই পেশায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে।
বৈরাগীপাড়ার এই মুড়ির কারবারীদের গৃহবধূরাই গ্রামে গ্রামে গিয়ে ভাল মুড়ি করার উপযোগী ধান কিনে আনে এবং জ্বালানী সংগ্রহ করে। পরে সেই ধান সিদ্ধ-শুকনা করে ঢেঁকিতে এবং মেশিনে সেই ধান ভেনে চাল করে এবং চালে লবণ পানি মিশিয়ে মাটির হাড়িতে ভাজা হয়। সেই সাথে পাশের অন্য চুলায় মাটির হাড়িতে গরম হয় মিহি বালু। চাল ভাজা হলে তাতে ঢেলে দেয়া হয় আগুনে তাঁতানো গরম বালু। আর মুহুর্তেই চাল থেকে ভুর ভুর করে ফুটে ওঠে শুভ্র শিউল ফুলের পাঁপড়ীর মতো সাদা মুখরোচক মুড়ি। গরম মুড়ি চালুনীতে ঢেলে বালু ঝেড়ে রাখা হয় চটের বস্তায়। মুড়ি ভাজা হলেই মেয়েদের দায়সারা। পরে তা বাজারজাত করার দায়িত্ব বর্তায় পুরুষদের উপর। মধ্যস্বত্বভোগী পাইকাররাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়ি থেকে মুড়ি কিনে নিয়ে যায়। আবার অনেকে মাথায় বস্তা বোঝাই মুড়ি নিয়ে ফেরী করে বিক্রি করে দোকানে দোকানে নয়তো বাসা বাড়ীতে। অধিকাংশ মুড়ি কারবারী অতিদরিদ্র। সে জন্য অর্থাভাবে মধ্যস্বত্বভোগী পাইকারদের কাছে আগাম টাকা নিয়ে বা দাদন ব্যবসায়ীর কাছে চড়া সুদে টাকা নিয়ে তাদেরকে মুড়ির কারবার চালাতে হয়। সে জন্য তারা এ থেকে লাভ যা পায়, তা অতি সামান্য। যা দিয়ে তাদের জীবন ধারণ করাই দু:সাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এব্যাপারে মুড়ির কারিগররা জানান, সাম্প্রতিকালে মেশিনে তৈরী করা মুড়ি এসে বাজার দখল করায় এই মুড়িওয়ালারা আরও বেশি বিপাকে পড়েছে। তবুও আশার কথা এই, ইউরিয়া মেশানো মেশিনজাত মুড়ির সাইজ বড় হলেও মুড়ির আদি স্বাদ তাতে একেবারেই নাই। সে জন্য এখনও গ্রামীণ এই মুড়িওয়ালাদের মাটির খোলায় ভাজা মুড়ির চাহিদা অনেক বেশি। কেন না, এদের মুড়ি সুস্বাদু এং স্বাস্থ্যসম্মত।
মুড়ি ভাজার এই পেশাদার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তাদের আদি পেশা টিকিয়ে রাখতে সহজ এবং ঐতিহ্যবাহী মাটির খোলায় ভাজা দেশীয় জাতের গ্রামীণ এই মুড়ি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ দেয়া অত্যন্ত জরুরী। আর্থিক সহায়তা পেলে তারা এ থেকেই আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে সক্ষম হবে বলে মুড়ির কারিগররা জানান।