উপ-সম্পাদকীয়:
হঠাৎ মনে হলো কিছু একটা লিখতে হবে। কিন্তু কী লিখব? ভাবলাম একটা সহজ লেখা লেখব। যা আমি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। আসলে মানুষ যে কর্মে ডুকে, যা তার মনের মধ্যে লালন করে, বুকের মধ্যে ধারণ করে, তা প্রতিষ্ঠিত করতে এবং বাস্তবায়ন করতে এ স্বল্পায়ু সময়টুকু ব্যয় করেন। আমি যা বিশ্বাস করি, তা বাস্তবায়নের জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। তা হলো “গুনগত মানসম্মত শিক্ষা”। প্রথমেই আসা যাক শিক্ষা কী? শিক্ষার নানাবিধ সংজ্ঞা আমরা বিভিন্ন দার্শনিক, কবি, সহিত্যিকের লেখনির মাধ্যমে পেয়েছি। সে গুলো পড়েছি, মুখস্ত করেছি। অন্যকে শিখিয়েছি। হয়তো কোনো কাজে বা প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে শিক্ষার সেই সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বা লিখে প্রথম স্থান বা ২য়, ৩য় হয়ে পুরস্কার পেয়েছি এবং সার্টিফিকেট ও অর্জন করেছি। কিন্তু তার পরও কোথায় যেন একটু পিছু টান থেকেই যাচ্ছে।
অনেক দিন আগে কথা। যখন সম্ভবত সিক্স/সেভেনে পড়ি, তখন বাংলা ক্লাসে শ্রেণি শিক্ষকের কাছ থেকে শুনে ছিলাম “শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড”। আসলে তখন ভালো করে এর মর্মার্থ বুঝতে পারিনি। তখন ভাবতাম পুঁথিগত বা অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষাই হচ্ছে একমাত্র শিক্ষা! কিন্তু না, যতই দিন গড়াতে শুরু হলো আমার ভাবনাও আরও গভীরে যেতে লাগল- পুঁথিগত শিক্ষা নাকি কারিগরি শিক্ষা, নাকি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা। আসলে কোন শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। কোন শিক্ষায় জাতি শিক্ষিত হলে সে জাতির মূল্যবোধ উঁচু হয়? কোন শিক্ষায় জাতি শিক্ষিত হলে সে জাতি পিছিয়ে পড়ে না? দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, জীবিকার তাগিতে যথন ইউআরসি ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলাম। তখন শিক্ষার অনেক সংজ্ঞা পেলাম। পেলাম এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তখন বুঝতে পারলাম “শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড” এ কথাটি ১০০% সঠিক। কারণ প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, মানসিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধন, স্বজনশীলতায়, বিজ্ঞান মনস্কৃতায় এবং তাকে উন্নত জীবনের স্বপ দর্শনে উদ্ধৃদ্ধ করা।
এখন আসা যাক, “গুনগত মানসম্মত শিক্ষা কী? আমি দীর্ঘদিন ইউআরসি ইনষ্ট্রাক্টর হিসেবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ প্রশিক্ষণ পরিচালনা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করতে গিয়ে গুণগত মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বলতে যতটুকু বুঝেছি তা হলো শিশু যে পাঠটুকু গ্রহণ করবে সে পাঠ থেকে শিশুর বয়স ও মেধা অনুযায়ী যে যে প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হবে, শিশু যদি তার নিজের মতো করে- সেই প্রশ্নের উত্তর গুলো বলতে বা লিখতে পারে এবং নিজের জীবনে প্রয়োজণের সময় অর্জিত শিক্ষার আলোকে বাস্তবে ইতিবাচক ভাবে প্রয়োগ করতে পারে তাকে বলা যায় “গুণগত মানসম্মত শিক্ষা”।
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষঅর সফল বাস্তবায়নে যে কাজ গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা হলো জরিপ এলাকা নির্দিষ্ট করা, শিশু জরিপ সম্পন্ন করা, জরিপ থেকে সকল শিশুর ভর্তি সম্পন্ন করে শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং বই বিতরন ও উপবৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বেষ্টনের মধ্যে ধরে রাখা ও ঝরে পড়া রোধ করা।
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারও নানা কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। যেমন- শিক্ষকদের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যালয়ের ভৌত কাঠামোর উন্নয়ন, বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ, স্লিপ কার্যক্রম, ওয়াশ ব্লক নির্মাণ সহ নানা বিধ উন্নয়ন করে যাচ্ছেন। এত কিছুর পরও প্রাথমিক শিক্ষার বর্তমান সময়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে এর গুনগত মান উন্নয়ন। সরকার এ সমস্যা নিরসনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাজ্য সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (উবঢ়ধৎঃসবহঃ ভড়ৎ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ উবাবষড়ঢ়সবহঃ- উঋওউ) সাথে এক যৌথ কর্মসূচীর আওতায় এস্টিম নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এস্টিম এমন একটি প্রকল্প যার রয়েছে একটি স্বপ্ন। এ স্বপ্নের কেন্দ্রে রয়েছে সফল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রূপ রেখা। সফল বিদ্যালয় হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে-
প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, দক্ষ, নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
শিশু নিরাপদ, সুস্থ ও আনন্দ ঘর পরিবেশে পরিবেশে শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়।
শিশু তাদের শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টি ভঙ্গি অর্জন করে।
স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা, জবাব দিহিতা ও সামাজিক মালিকানার ধারনা সর্বস্তরে স্বীকৃতি পায়।
বর্তমানে বিদ্যালয় গুলোতে সকল শ্রেণির শিশুর প্রতি জরিপ চালিয়ে দেখা যায় সেখানে বিভিন্ন মেধাস্তরের শিক্ষার্থী রয়েছে। এমতাবস্থায় সকল শিশুর জন্য মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে বিদ্যালয় ভিত্তিক বেছ লাইন সারবেছ স্তর ভিত্তিক পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে এবং ত্রৈমাসিক এ্যাকসন প্লান এর মাধ্যমে সকল শিশুর গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
প্রতিটি নিড বেছ সাব ক্লাষ্টার পরিক্ষণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় থেকে শিক্ষকদের উন্নয়নের ক্ষেত্র সমূহের চাহিদা চাওয়া হয় এবং সেই আলোকে নিড বেছ সাব ক্লাষ্টার প্রশিক্ষণ হয়। স্কুল পর্যায়ে এর জবাব দিহিতা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে ফলোআপ ভিজিট করা হচ্ছে। ফিড ব্যাক দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে গুণগত মান উন্নয়নে বিদ্যালয় ভিত্তিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিষয় ভিত্তিক টার্গেট দেওয়া ও চাওয়া হচ্ছে।
পরিশেষে বলব, শিক্ষক অভিভাবক সহ আমরা যারা এ শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে জড়িত তারা যদি প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্যটি অন্তরে ধারণ করে শিক্ষার্থীর স্বার্থে দেশপ্রেম উদ্ধৃদ্ধ্ইয তাহলে অচিরেই গুণগত মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন করে আমরা আমাদের ইস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।
লেখক-মোসাম্মদ নাসরিন জাহান পপি
ইনট্রাক্টর, ইউ.আর.সি, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ।