আজ রবিবার, ১৩ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৮শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মাদারীপুরে মানসিক ভারসম্যহীন নারীর সন্তান প্রসব, নবজাতকের দায়ভার সরকারী কর্মকর্তার হাতে হস্তান্তর

মাদারীপুরে মানসিক ভারসম্যহীন নারীর সন্তান প্রসব

মাদারীপুরে মানসিক ভারসম্যহীন নারীর সন্তান প্রসব, নবজাতকের দায়ভার সরকারী কর্মকর্তার হাতে হস্তান্তরমাদারীপুরে মানসিক ভারসম্যহীন নারীর সন্তান প্রসব

শহিদুল ইসলাম লিখন, মাদারীপুর, ॥
‘আমি পাগল না। ওরা আমারে মারে। ইট লাগায়। খাইতে দেয় না’-কথাগুলো বলে চুপ হয়ে যায় মানসিক ভারসাম্যহীন সদ্য মা হওয়া সালমা (২০)। আর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ভূমিষ্ট শিশুর দিকে। শিবচর উপজেলার পৌর এলাকার হাতিরবাগান মাঠের বালুর মধ্যে একটি শিশুর জন্ম দেয় মানসিক ভারসাম্যহীন এই সালমা। গত ৭/৮ মাস ধরে শিবচরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় তাকে। পরিচয় বা নিজ ঠিকানাও জানে না সে। বিকৃত লালসার শিকার মানসিক ভারসম্যহীন এই নারীর দিন কাটে পথে-প্রান্তে। ময়লা আর জরাজীর্ন পোশাক, নোংড়া আবর্জনা ঘেঁটে এবং বিভিন্ন দোকান থেকে চেয়ে-চিন্তে খেয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাকে। সমাজবর্জিত এ নারীও রেহাই পায়নি বিকৃত মস্তিষ্ক পাষন্ড কোন ব্যক্তির লালসার হাত থেকে। অবশেষে ৪দিন পর শনিবার রাত ১০টায় পিতৃপরিচয়হীন এই নবজাতককে সিলেটের নিঃসন্তান এক সরকারী কর্মকর্তা দম্পতির হাতে হস্তান্তর করে শিবচর প্রশাসন। তবে দত্তক নেওয়া ঐ দম্পতি গণমাধ্যম কর্মীদের নাম প্রকাশ ও ছবি না তুলতে অনুরোধ করেছেন। শিশুটির ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তাদের পরিচয় তুলে ধরতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এদিকে সিদ্ধান্ত হয় মানসিক ভারসাম্যহীন মা সালমাকে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ্য করে তোলার।
হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০ ফেব্র“য়ারি মঙ্গলবার একুশের প্রথম প্রহরের আর মাত্র আড়াই ঘন্টা বাকি। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। চার বন্ধু লিটু, অমি, রাজিব ও সাগর রাস্তার পাশে মাঠের এককোণে বসে গল্প করছিল। এসময় হঠাৎ একটি নারী কন্ঠের চিৎকার স্তব্ধ করে দেয় তাদের। দ্রুত ছুটে যায় সেখানে। দেখে রক্ত আর বালুতে মাখামাখি অবস্থায় মাঠে বালুর মধ্যে চিৎকার করছে একটি নবজাতক। পাশেই করুণ দৃষ্টিতে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া নবজাতকের গর্ভধারিনী। তখনো শিশুটির নাড়ির সাথে মায়ের নাড়ি একত্রিক। হতভম্ব কিংকর্তব্যবিমূঢ় চার বন্ধু। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। আসে পাশে কয়েকজন মহিলার সাহায্য চায় তারা। কিন্তু কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। ওরা চার বন্ধু পরামর্শ করে নবজাতক ও তার মাকে শিবচর হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালেই নাড়ি কাটা হয়। নবজাতক ও তার মা সালমা সুস্থ্য বলে নিশ্চিত করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। স্বস্তি ফিরে আসে চার বন্ধুর মাঝে। এরই মধ্যে নবজাতক ও তার মায়ের প্রয়োজনীয় ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে দেয় তারা। সারারাত হাসপাতালেই থেকে যায় চার বন্ধু। চার বন্ধু মিলে নবজাতক কন্যা সন্তানের একটি সুন্দর নাম রাখেন। জান্নাতুল হাবিবা নূরে হুমায়রা। হুমায়রা ও তার মা সালমাকে নিয়ে এখন সামাজিক গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে। কেউ কেউ কবিতা লিখছে, কেউ দিচ্ছে স্ট্যাটাস। বাদ পরছেনা মহানুভব চার বন্ধুও। মানবিক বিবেচনায় এরা নমস্য। হাসপাতালেই ডাক্তারদের পর্যবেক্ষণে থাকে সালমা ও হুমায়রা। এ ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্যান্য নারী রোগীরা জানান, সালমাকে দেখলে পাগল মনে হয় না। সন্তানের প্রতি প্রবল মাতৃত্ববোধ বোঝা যায়। সন্তান কোলে করে বসে থাকে। আদর করে। আবার মাঝে মধ্যে নিরবে কাঁদতেও দেখা যায়। অনেকে হাসপাতালে দেখতে আসছেন শিশুটিকে। প্রয়োজনীয় খাবারও কিনে দিয়েছে কেউ কেউ। শনিবার রাতে যখন শিশুটিকে হস্তান্তর করা হয় তখন সালমাকে কাঁদতে দেখা গেছে।

শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. আবু জাফর বলেন, ‘নবজাতক ও তার মাকে ডাক্তার ও নার্সদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। শিশুটি ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। এখানে তাদের সুচিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। মা ও শিশু উভয়ই সুস্থ আছে।’
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, বাচ্চার মা ও বাচ্চাটি সুস্থ্য তাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। বাচ্চাটির ভবিষ্যৎ চিন্তা করে একটি ভালো সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন পরিবারগ্রহণ করেছে। বাচ্চাটিকে তিনি (সরকারী কর্মকর্তা) পিতা এবং তার স্ত্রী এই সন্তানের মা হিসেবে লালন-পালন করবেন। আজ থেকে বাচ্চাটি তাদের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে তারা গ্রহণ করেছেন।