আজ মঙ্গলবার, ১৮ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ভাষা সৈনিক নূরুল হক ভূঁইয়ার অবদানের জন্য মরণোত্তর একুশে পদকের দাবী

ভাষা সৈনিক

ভাষা সৈনিক

গাজী মোবারক : ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা অস্তগামী হলে দু’শ বছরের স্বাধীকার আন্দোলনে বাংলার পরাক্রমশালী নেতাদের রাজপথে সংগ্রাম করে আত্মহুতির শেষ পরিনতি ৪৭’র দেশভাগ। বৃট্রিশ শাসনের অবসান হলেও ভ্রান্ত দ্বি-জাতিতত্বে বাঙালী আবারো পাকিস্তানীদের পিঞ্জরবন্দী হয়ে পরাধীন জাতি হিসেবে নতুন সমস্যায় আবদ্ধ হয়। জাতীয় নেতৃবৃন্দ খুব অল্প সময়ে বুঝতে পারেন পাকিস্তানীরা বাঙালীদের পরাধীন করে চাকরের মতো রাখতে চাইছেন। পাকিস্তানীরা জানতো বীর বাঙালীকে কখনো দাবিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। তাই পরিকল্পিতভাবে বাঙালীর কন্ঠ চিরতরে স্তব্দ করে দিতে বাংলাভাষাকে নিশ্চিহ্ন করার পায়তারা করে। প্রথম আঘাত আসে বাঙালীর মাতৃভাষার উপর। যেখানে ৫৬% মানুষের কথা বলার একমাত্র মাধ্যম মাতৃভাষা বাংলা সেখানে বাংলাকে উপেক্ষা করে ঘোষনা করেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে গর্জে ওঠে বীর বাঙালী। ৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের সাথে সাথেই কলকাতার সিরাজদৌলা হোটেলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। সে প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় আন্দোলনের প্রথম পর্যায়। ড. এ, এস, এম নুরুল হক ভুঁইয়াকে আহবায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এ ছাড়া তিনি তমদ্দুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমুদ্দন মজলিশ গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে এক আলোচনা সভা করে। অধ্যাপক নুরুল হক ভুঁইয়া, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, কবি জসীমউদ্দিন প্রমুখ সভায় বক্তব্য রাখেন। উল্লেখিত সভা থেকেই ‘অধ্যাপক নুরুল হক ভুঁইয়াকে’ আহবায়ক করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের হলে হলে ব্যাপক প্রচারনা চালানো হয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মীরা ছাত্র-জনতার সঙ্গে মিশে ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকেন। তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে পুরান ঢাকার বলিয়াদি প্রেসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যথার্থতা তুলে ধরে লিফলেট ও পুস্তিকা ছাঁপানো হয় এবং সর্বসাধারনের মাঝে বিতরন করা হয়। প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নুরুল হক ভ’ঁইয়া স্বাক্ষরিত এক বিবৃতি ১৯৪৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে চলমান আন্দোলনে শরীক হওয়ার জন্য সর্বসাধারনের প্রতি আহবান জানানো হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী করাচিতে গণপরিষদের বৈঠকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী অগ্রাহ্য করা হয়। এর প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নুরুল হক ভ’ঁইয়া সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এটিই প্রথম ধর্মঘট। এছাড়া ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করা হয়। সেদিন সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল এবং ছাত্রদের পিকেটিংয়ে ঢাকা শহর বিক্ষোভের মিছিলে পরিনত হয়। ওইদিন কয়েকজন ছাত্র নেতাসহ ৬০/৬৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পুলিশী নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১২, ১৩, ১৪ মার্চ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করা হয়। ১৪ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানের তৎকালিন গর্ভনর জেনারেল (পরে প্রধানমন্ত্রী) খাজা নাজিমউদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেন। পরের দিন ১৫ মার্চ উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। দু’দফা আলোচনার পর নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের ৮-দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির পর গ্রেফতারকৃত ছাত্র নেতাদের মুক্তি দেয়া হয়। আন্দোলন ফলপ্রসু হয়েছে ভেবে সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনে কিছুটা ভাটা পড়ে যায়।
নূরুল হক ভুইঁয়া ১৯২৩ সালের ১লা মে সোনারগাঁ উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী সাহাবুদ্দিন ভুঁইয়া। ১৯৯৮ সালের ২ এপ্রিল তিনি ইন্তেকাল করেন। আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে যে ক’জন দিকপাল সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন , অধ্যাপক নুরুল হক ভ’ইয়া তাদের অন্যতম। অধ্যাপক নূরুল হক ভ’ঁইয়া ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে বিএসসি (অনার্স) এবং ১৯৪৫ সালে তিনি এমএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে তিনি অধ্যাপক হিসাবে অবসর গ্রহন করেন। দেশের বিজ্ঞান ও গবেষনায় তিনি অসাধারণ সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। পাটের অগ্নিরোধক মিশ্রন এবং দ্রুত গতিবেগ সম্পন্ন বিমান ও অন্যান্য ইঞ্জিনের ‘সলিড লুব্রিকেন্ট’ জাতীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তিনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন।
সোনারগাঁও প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাহিত্যিক বাবুল মোশাররফ বলেন, নূরুল হক ভ’ইয়ার এ অবদানের জন্য সরকারের কাছে সোনারগাঁয়ের সর্বস্তরের মানুষের দাবী তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক ।
প্রকৃতি প্রেমী ও লেখক হাজী মোহাম্মদ মহসীন জানান, ড. নূরুল হক ভূইয়াকে রাষ্ট্র তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করেছে এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়।
রাজনীতিবিদ গাজী মুজিবুর রহমান বলেন, সোনারগাঁয়ের একজন আলোকিত মানুষ ভাষা আন্দোলনের প্রথম আহ্বায়ক ছিলেন এাঁ আমাদেও জন্য অত্যন্ত গর্বের। মহান এ মানুষটির প্রাপ্য সম্মানের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ