অপরাধ প্রতিবেদক:
১৬ জানুয়ারী ২০১৮। নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। ফুতপাতে হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে সে দিন নারায়ণগঞ্জের একই দলের দুইটি অঙ্গনে ঘটে যায় তুমুল যুদ্ধ । সে সংঘর্ষে মেয়রসহ একাধীক হতাহতের ঘটনা ঘটে। ইস্যুটি ছিল নিছক হকারকে নিয়ে। নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনের দুই আলোচিত মুখ শামীম ওসমান ও মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। প্রকাশ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন যুক্তি দিয়েছেন। গণমাধ্যমের এই বিষয়টিকে আরো আলোচিত করে তুলে প্রচারের মাধ্যমে। সেদিনের সংঘর্ষেরসময় প্রানে রক্ষা পান মেয়র আইভী। তার কর্মী-সমর্থকরা মানব ঢাল সৃষ্টি করে আইভীকে রক্ষা করেছিলেন।
বিভিন্ন সূত্রে থেকে জানা যায়, ক্ষমতাশীন দলের গুটিকয় নেতার সমন্নয়ে পরিচালিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের হকার বানিজ্য । বর্তমানে যে সকল সেক্টরগুলোতে ব্যাপক চাঁদা বাণিজ্য হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়। এ সেক্টর থেকেই দৈনিক লক্ষাধীক টাকার বেশী চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছক এক চাঁদা উক্তোলনকারী জানান, ২ বছর ধরে আমি ২নং রেল গেইট এলাকার হকারদের কাছ থেকে লাইন মেন হিসেবে থেকে চাঁদা উক্তোলনকরী। আমি অনেক দিন যাবত এই লাইনে আছি। কেউ আমার পরিচয় জানলে আমাকে মেরে ফেলতে পারে। তাই পরিচয় গোপন রেখে এই প্রতিবেদক কে বলেন কয়েকজন নেতাকে আমি নিজ হাতে টাকা তুলে দিয়েছি। এ সকল হর্কাস নেতা ও চাঁদাবাজরা হকারদের সাথে বিভিন্ন মাধ্যমে যুক্ত হয়ে চাঁদা আদায় করে থাকে। এর পেছনে পুলিশের কিছু কর্মকর্তাও সুবিধার বিনিময়ে জড়িত।
অপরাধ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে চাঁদা আদায়ে সাথে জড়িত আট জনের নাম। এরা হচ্ছেন । রহিম মুন্সি, আসাদুজ্জামান আসাদ, আলমগীর হোসেন পলাশ, ভান্ডারী, হারুন মিয়ার ছেলে দারুন, পুলিশ পরিদর্শক সুরুজ মিয়া, আরিফ ও সোহেল। এসব চাঁদাবাজরা বছরে ২ কোটি ৫ লাখ টাকা শহরের ফুটপাত থেকে আদায় করছেন।
নারায়ণগঞ্জ হর্কাসলীগের সভাপতি রহিম মুন্সি শহরের চাষাড়াস্থ হর্কাস মার্কেট থেকে বঙ্গবন্ধু সড়কের আমান ভবন পর্যন্ত নিয়ন্তন করেন।এই সড়কের পূবদিক ২৫০ এর অধিক হকারের দোকান রয়েছে। প্রতিদিন দোকান প্রতি ৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে প্রতিদিন আনুমানিক ১২ হাজার ৫শ টাকা এবং মাসে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা চাঁদা আদা করে থাকে। বছরে চাঁদা আদায় হয় ৪৫ লাখ টাকা।
হর্কাস সংগ্রাম পরিষদের আহব্বায়ক আসাদুজ্জামান আসাদ নিয়ন্ত্রন করেন বঙ্গবন্ধু সড়কের গলাচিপা থেকে চাষাড়া মার্ক টাওয়ার পর্যন্ত। এ সড়কে আনুমানিক ১৫০ টি হকারের দোকান রয়েছে। প্রতিদিন দোকান প্রতি ৫০ টাকা করে যা দাড়ায় ৭ হাজার ৫শ টাকা। মাসে চাঁদা আদায় হয় ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ২৭ লাখ টাকা।
আলমগীর হোসেন পলাশ নিয়ন্ত্রন করেন ২ নং রেলগেইট থেকে ১ নং রেলগেইট পর্যন্ত। ফজর আলী মার্কেট থেকে উৎসব বাস কাউন্টার পর্যন্ত চেম্বার রোড সড়কের রেল লাইনের পাশে ১০০ টির অধিক দোকান। দক্ষিন পাশে ২ শতাধীক হকারদের দোকান রয়েছে। উত্তর পাশের প্রতি দোকান থেকে প্রতিদিন ১০০ টাকা করে ১০ হাজার টাকা দক্ষিন পাশে ২০ টাকা করে ৪ হাজার টাকা করে মোট দৈনিক আদায় হয় ১৪ হাজার টাকা। মাসে চাঁদার পরিমান দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ৫০ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
ভান্ডারী নিয়ন্ত্রন করেন নারায়ণগঞ্জ উৎসব কাউন্টার থেকে বন্দর সেন্ট্রাল খেয়াঘাট পর্যন্ত। এই এলাকায় আনুমানিক ৮০ টি হকারের দোকান রয়েছে। প্রতিদিন ৩০ টাকা করে দৈনিক ২ হাজার ৪শ টাকা। মাসে ৭২ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করেন। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।
ক্ষমতাশীন দলের পরিচয় দিয়ে দারুন নিয়ন্ত্রন করেন বর্ষন সুপার মার্কেট থেকে পূর্বপাড়ের করিম মার্কেট পর্যন্ত আনুমানিক ৫০ টির অধিক দোকান রয়েছে। প্রতিদিন দোকান প্রতি ৩০ টাকা করে দৈনিক ১৫শ টাকা। মাসে ৪৫ হাজার টাকা। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
২নং রেল গেইট পুলিশ বক্সের পুলিশ পরির্দশক সুরুজ মিয়া নিয়ন্ত্রন করেন মন্ডলপাড়া থেকে নগর পাঠাগার পর্যন্ত। তিনি এই সড়কের আনুমানিক ২০ টি ভ্যান গাড়ির দোকান থেকে প্রতি সপ্তাহে ভ্যান প্রতি ২০০ টাকা করে মাসে ১৬ হাজার টাকা ব্যক্তিগতভাবে আদায় করেন। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ২ লাখ টাকা।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের গলি থেকে পপুলার হাসপাতালের গলি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রন করেন আরিফ। এখানে দোকান বসে সব মিলিয়ে ১শ টির মতো। দোকান প্রতি চাঁদা তোলা হয় ১শ টাকা করে। দৈনিক ১০ হাজার টাকা হিসেবে মাসে উঠানো হয় ৩ লাখ টাকা। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ৩৬ লাখ টাকা।
কালীবাজার ব্যাংক মোড় থেকে ফ্রেন্ডস মার্কেট পর্যন্ত চাঁদা তোলেন সোহেল। এখানে দোকান আছে ১৫০টি। ৫০ টাকা করে টাকা দৈনিক ৭ হাজা ৫শ টাকা চাঁদা উত্তোলন করে থাকে। মাসে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ৩০ লাখ টাকা।
তালিকার এ সকল ব্যক্তিরা নিরীহ হকারদের জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন লক্ষাধীক টাকা। ক্ষমতাসীন দলের পরিচয় দিয়ে এবং কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকে মেনেজ করে চলছে চাঁদা তোলার মহা উৎসব। নগরবাসী চায় মুক্তভাবে ফুটপাত দিয়ে চলাচল করতে। এসব চাঁদাবাজদের আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করবে।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার হারুনুর রশীদ বলেন, আমাদের কোন পুলিশ সদস্য এর সাথে জড়িত নেই। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।