আজ মঙ্গলবার, ১৫ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৩০শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

তারাবতে কারখানা মালিকদের অনিয়ম

সংবাদচর্চা রিপোর্ট :

রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে গড়ে উঠেছে পরিবেশ দূষণকারী অসংখ্য শিল্প কারখানা। পৌরসভার রূপসী ও বরপা এলাকাতে পরিবেশ বিধ্বংসী এমন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। গতকাল শনিবার রূপসী ও বরপা এলাকা ঘুরে এমন বেশ কয়েকটি কারখানার সন্ধান মিলেছে।

এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য, তারাবোর বরপা এলাকায় অবস্থিত বুনাফাইড টেক্সটাইল লিমিটেড নামক একটি মশারি তৈরীর কারখানা, বরপা এলাকার সেবা সিএনজি পাম্প সংলগ্ন রিয়াজ কঞ্জুমার প্রডাক্ট নামক কয়েল তৈরীর কারখানা এবং একই এলাকার এসআইএফ টেক্সটাইল মিল্স নামক প্রতিষ্ঠান।

এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ কারখানার ব্যবহৃত কেমিকেলযুক্ত বিষাক্ত তরল বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই আশপাশের খালগুলোতে ফেলছে। যা খাল হয়ে পড়ছে নদীতে। এতে দূষণের মাত্রা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, খালে কারখানার তরল ও শক্ত বর্জ্য ফেলায় খাল বন্ধ হয়ে দূষিত পানি আশপাশের বাসিন্দাদের বাড়িঘরে প্রবেশ করছে। এতে তারাব পৌরসভার ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের কয়েক হাজার পরিবার সীমাহীন দূর্ভোগে পড়েছেন। জলাবদ্ধতার দুঃসহ দূর্ভোগের পাশাপাশি মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও রয়েছেন স্থানীয়রা।

ক্ষোভ প্রকাশ করে বরপা এলাকার সজল নামে এক বাসিন্দা দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, বছরের পর বছর এসব কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে সীমাহীন দূর্ভোগে পড়েছেন তারা। বর্ষা মৌসুমতো বটেই, শুষ্ক মৌসুমেও খাল উপচে দূষিত পানি তাদের বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করে থাকে। বর্ষা মৌসুমে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। পাশাপাশি আশপাশের রোলিং ও স্টীল মিলের কারখানার বিষাক্ত কালো ধোয়াতেও ছেয়ে যায় এলাকা। এতে অনেকেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, তারাবোর বরপা এলাকায় অবস্থিত বুনাফাইড টেক্সটাইল লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানটির কোন নাম ফলক বা সাইনবোর্ড নেই। নাম ফলক বিহীন ওই প্রতিষ্ঠানে তৈরী হয় মশারি। প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা রক্ষীদের একজন জানান, কারখানার মালিক জনৈক ওয়াহেদুজ্জামান। ওই কারখানা থেকে নির্গত কালো বিষাক্ত তরল বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই সরাসরি ফেলা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী একটি খালে। এতে ওই খালটি একেবারে দুষিত হয়ে পড়েছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন আশপাশের বাসিন্দারা। এই বিষয়ে কারখানার কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও নানা অযুহাত দেখিয়ে তারা কথা বলতে রাজি হননি। পরবর্তীতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হঔের তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

অন্যদিকে, একই এলাকার সেবা সিএনজি পাম্প সংলগ্ন রিয়াজ কঞ্জুমার প্রডাক্ট নামক কয়েল তৈরীর কারখানার কর্তৃপক্ষও তাদের কারখানার ক্যামিকেলযুক্ত বিষাক্ত পানি পরিশোধন ছাড়াই পার্শ্ববর্তী খালটিতে ফেলছে। এতে খালসহ আশপাশে ভয়াবহ দূষণ বাড়ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই প্রতিষ্ঠানেও ইটিপি ব্যবস্থা নেই। প্রতিষ্ঠানটির আনুসাঙ্গিক ছাড়পত্র নেই বলেও বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। এই বিষয়ে কারখানার মালিক পক্ষের বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও প্রধান ফটকে দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীরা জানিয়েছেন, কারখানা চলমান থাকলেও মালিকপক্ষের কেউ-ই ভেতরে উপস্থিত নেই। তারা এ-ও বলেছেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কিছুদিন আগেই কারখানাটি পরিদর্শন করেছেন। তবে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা- সেই বিষয়ে তথ্য দেয়নি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ফটকে দায়িত্বপালন করা কর্মীরা।

এদিকে, শনিবার রূপগঞ্জের বরপা এলাকায় অবস্থিত এসআইএফ টেক্সটাইল নামক প্রতিষ্ঠানে গিয়েও কর্মকর্তাদের বক্তব্যে নানা অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই কারখানার রঙিন পানি সরাসরি খালে ফেলা হচ্ছে। এতে দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয়দের অনেকেই অভিযোগ করে বলেছেন, প্রতিনিয়তই ওই কারখানার তরল বর্জ্য প্রকাশ্যে খালে ফেলা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ইটিপি ব্যবস্থা রয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নে দায়িত্বরত এক এ্যাডমিন অফিসার দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে ইটিপি রয়েছে এবং তারা নিয়মিত ইটিপি ব্যবহার করছেন বলে জানান। তবে ইটিপি আদৌ চলছে কিনা তা দেখতে চাইলে তারা বিভিন্ন অযুহাতে বিষয়টি এড়িয়ে যান।

তথ্য বলছে, রূপগঞ্জের রূপসি ও বরপা এলাকায় নামে বেনামে এমন ডাইং, টেক্সটাইল, কয়েল ও প্রিন্টিং কারখানার ছড়াছড়ি। তবে পরিবেশ দূষণকারী এসব প্রতিষ্ঠানের সঠিক তালিকা নেই পরিবেশ অধিদপ্তরেও।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘অবৈধ বা পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকাভুক্ত করতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। লোকবল সংকটের কারণে এই কাজ গতিশীল হচ্ছে না। তবে পর্যায়ক্রমে এসব প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা রূপগঞ্জ উপজেলার বরপা এলাকার ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে জানানো হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘অচিরেই এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর ইটিপি থাকলেও যদি কোন প্রতিষ্ঠান তা নিয়মিত ব্যবহার না করে, তাহলে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধেও নেয়া হবে আইনী ব্যবস্থা।’ রূপগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহ নুসরাত জাহান দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখবো এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। আর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলদের মাধ্যমে খোঁজ নিব। চাইলে লিখিত অভিযোগ দিতে পারেন।’

রূপগঞ্জের তারাবতে গড়ে উঠা এসব পরিবেশ দূষণকারী ও স্বাস্থ্যঝুঁকি মূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আগামীতেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে দৈনিক সংবাদচর্চা পত্রিকায়।