আজ বৃহস্পতিবার, ২৩শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বন্দরে র‌্যাবের অভিযানে জেএমবির নারী সদস্যসহ গ্রেফতার ০৩

জেএমবির নারী সদস্য

নিজস্ব প্রতিবেদক:
নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্য এবং জঙ্গী কার্যক্রম উগ্রবাদে সম্পৃক্তার অভিযোগে র‌্যাব ১১ এক নারীসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে।
মঙ্গলবার (১৭ এপ্রিল) বন্দরের সোনাকান্দা এলাকা থেকে তাদেরকে আটক করে র‌্যাব।
আটককৃতরা হলো- জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু (১৯), মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদ (২২) এবং আকবর হোসেন সুমন (৩০)।
বুধবার (১৮ এপ্রিল) র‌্যাব ১১ এর সিনিয়র এএসপি শেখ বিল্লাল হোসেন স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব জানায়, গত ০২ এপ্রিল তারিখে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ নিবাসী মোঃ নুরুল ইসলাম তার মেয়ে-জামাই জুয়েলসহ র‌্যাব-১১ কার্যালয়ে এসে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে যে, তার মেয়ে জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু (১৯) জঙ্গী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত এবং সে রাষ্ট্র বিরোধী ও নাশকতামূলক কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়ার জন্য তার ০২ বছরের শিশু সন্তান রোজা আক্তারসহ ৩১ মার্চ ২০১৮ তারিখে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। তারা দ্রুত তাকে আইনের আওতায় আনার জন্য অনুরোধ জানায়। এই প্রেক্ষিতে র‌্যাব-১১ কর্তৃক গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করাসহ নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে একাধিক অভিযান পরিচালনা করা হয়। অবশেষে, গত ১৭ এপ্রিল ২০১৮ তারিখ ১৯১৫ ঘটিকার সময় নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানাধীন সোনাকান্দা এলাকা থেকে র‌্যাব-১১ এর একটি আভিযানিক দল জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু (১৯) কে তার দুই সহযোগী মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদ (২২), থানা-রাউজান, জেলা-চট্টগ্রাম এবং আকবর হোসেন সুমন (৩০), থানা-হাতিয়া, জেলা-নোয়াখালী, এ/পি-পাহাড়তলী, চট্টগ্রামদেরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে উগ্রবাদী বই ও লিফলেট উদ্ধার করা হয়। অভিযানকালে মিতুর ০২ বছরের শিশু সন্তান রোজা আক্তারকেও উদ্ধার করা হয়।
র‌্যঅব আরও জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জান্নাতুল নাঈম@ মিতু (১৯) জানায় যে, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ফেইসবুক আইডি আল্লাহর সৈনিক এর মাধ্যমে জনৈক মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদের সাথে তার পরিচয় হয়। মেহেদী তাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে কাজ করার আহবান জানিয়ে জসিম উদ্দিন রাহমানির উগ্রবাদী বক্তব্য সম্বলিত বিভিন্ন বক্তব্য সরবরাহ করে। এ প্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে সে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হলে তাকে জেএমবির দাওয়াত দেয়। এছাড়াও নামায আদায় না করলে ও দাঁড়ি না রাখলে তার স্বামীকে পরিত্যাগ করা উচিত বলে বিভিন্ন ফতোয়া প্রদান করে। মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদ তাকে বাংলাদেশ সরকার ও ত্বাগুত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হওয়ার আহবান জানালে জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু তাতে সাড়া দেয়। এরপর থেকে মিতু তার ফেইসবুক আইডি ‘এসো ইসলামের পথে’ এবং ‘আলোর পথ ইসলাম’ থেকে বিভিন্ন যুদ্ধ, অস্ত্র ও গোলাবারুদের স্থিরচিত্র এবং ভিডিও সহ বিভিন্ন উগ্রবাদী মতবাদ প্রচার করতে থাকে। সে তার কাছের বন্ধু-বান্ধবদের কথিত জিহাদের দাওয়াত দেওয়া শুরু করে। জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু তার স্বামী জুয়েলকে উগ্রবাদের পথে আসার আহবান জানিয়ে ব্যর্থ হলে স্বামীকে ত্যাগ করে কথিত শহীদি মৃত্যু বরণ করার লক্ষ্যে হিযরত করার পরিকল্পনা করে। তার পরিকল্পনার কথা মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদকে জানালে সে তাকে মাহরাম ছাড়া হিযরত করা যাবেনা বলে জানায় এবং তার বন্ধু আকবর হোসেন সুমনকে মাহরাম হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেয়। এরপর মেহেদী তার বন্ধু আকবর হোসেন ওরফে সুমনের সাথে মিতুর যোগাযোগ করিয়ে দেয়। সুমনকে মাহরাম হিসেবে পাওয়ার জন্য জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতুু তার স্বামী জুয়েলকে ডির্ভোস দেওয়ার পরিকল্পনা করে। সুমন ও মেহেদীর পরামর্শ অনুযায়ী জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু গত ৩১ মার্চ ২০১৮ তারিখে সোনারগাঁয়ের তার নিজ বাড়ি থেকে চট্টগ্রামে চলে যায়। সুমন ও মেহেদী তাকে সেখানে একটি ভাড়া বাসা ঠিক করে দেয়। তারা দুজনে জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতুকে শহীদ হওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের কৌশল ও পরামর্শ প্রদান করে এবং জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতুুকে শহীদি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে। পরে তারা নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও ঢাকার কয়েকজন জেএমবি সদস্যের সাথে যোগাযোগ করে সংগঠনের কর্মী সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সফরের পরিকল্পনা নেয়। এ লক্ষেই তারা নারায়ণগঞ্জে একত্রিত হয়েছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়। উল্লেখ্য যে, মিতু ২০১৭ সালে মেঘনা শিল্পনগরী স্কুল এন্ড কলেজ, সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ হতে এসএসসি পাশ করেছে এবং একই কলেজে এইচএসসি অধ্যয়নরত।
আটককৃত মোঃ মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদ (২২) ২০০৫ সালে আমিরহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় রাউজান চট্টগ্রাম হতে ৫ম শ্রেনী পাশ করে। পরবর্তীতে ফটিকছড়ি মাইজভান্ডার হেফজখানাতে ৩/৪ বৎসর পড়ালেখা করে। সে ২০১১ সাল হতে চট্টগ্রামের হালিশহর ও ইপিজেড এলাকায় একটি ফুড প্রোডাক্টস্ কোম্পানীতে সেলস্ ম্যানেজার হিসেবে চাকুরী করে। ২০১৫ সালে সে জনৈক সামি ভাই এর মাধ্যমে হানাফি থেকে সালাফি মতাদর্শে দীক্ষিত হয়। এরপর উক্ত সামি ভাই তাকে উগ্রবাদী বিভিন্ন বয়ান শুনতে ও কিছু বই পড়তে দেয়। পরবর্তীতে এ সকল বয়ান ও বইয়ের মাধ্যমে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়ে সে বিভিন্ন সালাফি মসজিদে যাতায়াত শুরু করে।
২০১৫ সালের শেষদিকে সামি তাকে অপর এক দ্বীনি ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে মেহেদী দাওয়াতী কাজে ব্যাপকভাবে তৎপর ছিল। এসময়ে সে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় সফর করে জেএমবির কর্মী সংগ্রহ করেছে। ২০১৮ সালে সে কয়েকবার নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও সোনারগাঁয়ে সফর করে বিভিন্ন গোপন মিটিং ও জেএমবির কর্মী সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রেখেছিল। সে বিভিন্ন সময়ে দ্বীনি বোনদেরকে পর্দার আড়াল থেকে জেএমবির আদর্শিক বয়ান প্রদান করত এবং বাংলার মাটিতে জিহাদ কায়েম করার জন্য একনিষ্ঠভাবে ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানাত। এর সুবাদে একাধিকবার মিতুর সাথে সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন জায়গায় মেহেদীর দেখা হয়। মেহেদী সরাসরি দাওয়াতী কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও উগ্রবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করত।
আটককৃত মোঃ আকবর হোসেন ওরফে সুমন (৩০) ২০০৩ সালে চর আমান উল্লাহ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাতিয়া, নোয়াখালী হতে ৫ম শ্রেনী পাশ করে। এরপর চর আমান উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি হয়ে আর লেখাপড়া করেনি। ২০০৭ সাল থেকে সে চট্টগ্রামের হালিশহরে একটি বেকারীর সেলস্ম্যান হিসেবে চাকুরী করে আসছে। ২০১৬ সালের শেষ দিকে এই চাকুরীর সুবাদে অপর একটি ফুড প্রোডাক্টস কোম্পানীর সেলস্ ম্যানেজার মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদ এর সাথে তার পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের মাধ্যমে মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদ, সুমনকে উগ্রবাদের দাওয়াত দেয় এবং তাকে বিভিন্ন উগ্রবাদী বই পড়তে ও উগ্রবাদী বয়ান শুনতে বলে। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারনা দিতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সুমন জেএমবির সাথে জড়িয়ে পড়ে। এরপর সুমন এবং মেহেদী একত্রে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করে সংগঠনের সদস্য সংগ্রহের কাজ করে। সে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ পুলিশ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের উস্কানীমূলক বক্তব্য ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করে সকলকে জঙ্গী কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করাসহ নিজেকে ইস্তেশহাদির জন্য প্রস্তুত করে। মেহেদীর মাধ্যমে মিতুর সাথে সুমনের পরিচয় হয়। সুমন মিতুকে হিযরত করে শহীদি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন প্রকার অপব্যাখ্যা প্রদান করে। সে এ পর্যন্ত ১০-১২ জনকে জেএমবির আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে সংগঠনে অন্তর্ভূক্ত করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।
জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু হিযরত করে চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পর সে ও মেহেদী হাসান মাসুদ মিলে মিতুকে বাসা ভাড়া করে দেয়। পরবর্তীতে সুমন ও মেহেদী মিতুকে নিয়ে কর্মী সংগ্র্রহ করাসহ পরিচিত জেএমবি সদস্যদেরকে হিযরতে আহবান করার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সফরের পরিকল্পনা করে নারায়ণগঞ্জে আগমন করে।
র‌্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।