আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

গভীর ঘুমে রাজউক

সংবাদচর্চা রিপোর্ট :

বেইলী রোডে ভয়াবহ দূর্ঘটনার পর নারায়ণগঞ্জের ভবনগুলোও ঝুঁকিপূর্ন উল্লেখ করে স্থানীয় গণমাধ্যমে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ায় টনক নড়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশনের। তবে এখনো যেন বিভোরে ঘুমোচ্ছে রাজউক কর্মকর্তারা। গতকাল দুপুরে ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে একটি টিম নগরীর বিভিন্ন অভিজাত রেস্টুরেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট ভবন পরিদর্শন করলেও সেখানে অংশ নেয়নি রাজউক।
এদিকে, প্রায় প্রতিটি ভবন এবং ভবনে থাকা রেস্টুরেন্টগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘটতিসহ ঝুঁকির বিষয়টি দৃশ্যমান হলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি ফায়ার সার্ভিস কিংবা সিটি করপোরেশনকে। সচেতনতার বুলি আউরে যেন দায় সেরেছেন তারা। তা নিয়ে সচেতন মহলে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে, আবাসিক ভবনগুলো বাণিজ্যিককরণ এবং বিল্ডিং কোডের আইন লঙ্ঘণের বিষয়টি সুস্পষ্ট হলেও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এই বিষয়ে নীরব থাকায় রহস্যের দানা বেধেছে জনমনে।
সরেজমিনে জানা গেছে, চাষাড়া শহীদ মিনারের পাশে অবস্থিত সুবিশাল ৮ তলা ভবনের পুরোটাতেই ভাড়া দেয়া হয়েছে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট। রয়েছে সুলতান ডাইন ও ডাইনিং লাউঞ্জের মত অভিজাত ১২টি রেস্টুরেন্ট। অথচ এটি আবাসিক ভবন। ইতিপূর্বে এখানে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে মানুষ বসবাস করলেও ব্যবসার চাহিদা এবং অধিক ভাড়া বিবেচনায় অনিয়মে জড়িয়েছে মালিক পক্ষ। অবকাঠামোগত পরিবর্তন এবং সাজসজ্জার মাধ্যমে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট কোম্পানীর কাছে ফ্লোর ভাড়া দিয়ে বাণিজ্যিক ভবণে পরিণত করা হয়েছে আবাসিক ভবনগুলোকে। পাশর্^বর্তী মনির টাওয়ারটিও আবাসিক ভবন হলেও এর নিচ থেকে ৩ তলা অব্দি রেস্টুরেন্টে পরিণত করা হয়েছে। রয়েছে ‘কাচ্চি ভাই’ সহ সিরাজ চুই গোস্তের মত নামি-দামি রেস্টুরেন্ট।
আবাসিক ভবন বাণিজ্যিকে রূপ দিলেও এই বিষয়ে মাথা ব্যাথা নেই রাজউক কর্মকর্তাদের। এযাবৎ সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসও ছিলো নীরব ভূমিকায়। যদিও বেইলি রোডের ঘটনার পর এবারই প্রথম দুই সংস্থাকে খোলসমুক্ত হতে দেখা গেছে।
তবে এখনো দেখা যায়নি রাজউক কর্মকর্তাদের। এই বিষয়ে জানতে গতকাল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক-৮ জোনের পরিচালক ইয়াহ হিয়া খানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি তার ব্যবহৃত মুঠোফোনটি রিসিভ করেননি।
জানা গেছে, গতকালের পরিদর্শন টিমে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহাম্মেদ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবীদ মঈনুল ইসলাম, সিটি করপোরেশনের মেডিকেল অফিসার ডা. শেখ মোস্তফা আলী এবং ফুড এন্ড স্যানিটেশন অফিসার মো. আলমগীর হিরণ।
জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের ফুড এন্ড স্যানিটেশন অফিসার মো. আলমগীর হিরণ দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘বেইলী রোডের ঘটনার পর নারায়ণগঞ্জের ভবন এবং রেস্টুরেন্টগুলোর ফায়ারের ব্যবস্থাপনা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিসের সমন্বয়ে এই টিম গঠিত হয়েছে। প্রায় ২০-২২টি রেস্টুরেন্টে পরিদর্শনে গিয়ে আমরা দেখেছি যে, রান্না ঘরগুলো ঝুঁকিপূর্ন এবং ভবনগুলোতেও ফায়ার এক্সিট সহ আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ রেস্টুরেন্টের সিলিন্ডারগুলো তাদের রান্না ঘরের ভিতরে রাখা হয়েছে। শহীদ মিনারের পাশর্^বর্তী ৮তলা বিশিষ্ট রেস্টুরেন্ট ভবনটিতেও দেখা গেছে যে, প্রতিটিতেই রান্না ঘরের ভিতরে সিলিন্ডারের বোতল রাখা হয়েছে। এছাড়াও তাদের এই ভবনগুলোতে ফায়ার এক্সিট বা ইমার্জেন্সি সিঁড়ি সেই। কেএফসিতেও একই অবস্থা দেখা গেছে। প্রত্যেককে সচেতন করে আসা হয়েছে, হয়তো পরে অভিযান চালানো হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভবনগুলো বাণিজ্যিক নাকি আবাসিক, তা দেখতে নকশা এবং কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। ভবন মালিকরা তাদের কাগজপত্র নিয়ে সিটি করপোরেশনে যোগাযোগ করবে। যেহেতু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নগর পরিকল্পনাবীদ মঈনুল স্যার নেতৃত্ব দিয়েছে, সেহেতু এই বিষয়ে তিনি ভালো বলতে পারবেন।’
এই বিষয়ে জানতে নগর পরিকল্পনাবীদ মঈনুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক মো. ফখর উদ্দিন আহম্মেদ দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘আমরা অভিযান নয় পরিদর্শনে গিয়েছি। যেসকল রেস্টুরেন্ট এবং ভবনে সমস্যা দেখেছি, তাদের সচেতন করা হয়েছে। অভিযান হিসেবে পরে আবার যাবো। সকলের কাগজপত্র চেয়েছি। মালিকদের পাইনি। সিটি করপোরেশন থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলো। তারা ভবনগুলোর নকশা এবং কাগজপত্র দেখতে চেয়েছে। কিন্তু ওই মুহুর্তে কেউ তা দেখাতে পারেনি। মালিক পক্ষকে বলা হয়েছে যে, কাগজপত্র নিয়ে সিটি করপোরেশনে হাজির হতে।’
ফায়ার সেফটির অব্যবস্থাপনার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের করণীয় কী- এমন প্রশ্নের জবাবে ফখর উদ্দিন বলেন, ‘আমরা মালিকপক্ষকে বলে এসেছি যে, যেসকল প্রতিষ্ঠানে ফায়ার সেফটির বিষয়গুলো সঠিক নয়, সেগুলো যেন তারা ঠিক করে রাখে।’
এদিকে, ভবনগুলোতে অব্যবস্থাপনা এবং রেস্টুরেন্টগুলোতে দূর্ঘটনার ঝুঁকি মাথায় নিয়েও ফায়ার সার্ভিস এবং সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা সচেতনতামূলক বুলি আউড়ানোর মাধ্যমে যেই নমনীয়তা দেখাচ্ছেন, তাতে উদ্বেগ বেড়েছে স্থানীয়দের মাঝে। তাদের মতে, এখনই কঠোর না হলে যেকোনো সময়ে ঘটতে পারে ভয়াবহ কোনো দূর্ঘটনা, লিখা হতে পারে দুঃসহ কোনো ট্র্যাজেডির লোমহর্ষক গল্প। সেই অপেক্ষাতেই কী বসে থাকবেন দায়িত্বশীলরা! এমন প্রশ্ন থেকেই যায়।