সংবাদচর্চা রিপোর্ট:
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ক্রমেই দূর্বল হয়ে আসছে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি। এক সময় বিএনপি’র আন্দোলন-সংগ্রামে নারায়ণগঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে ।
সরেজমিনে দেখা গেছে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, হাইব্রীড নেতাদের দলে অন্তর্ভুক্তি আর নির্বাচনের মনোনয়ন টিকিট হাসিলের পায়তারায় দলীয় কোন কর্মসূচিকে আর সফল করতে একাট্টা হতে দেখা যায় নি নারায়ণগঞ্জ বিএনপিকে।
২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি ও মহানগর বিএনপি’র কমিটি দেয়া হয়। ২৬ সদস্য বিশিষ্ট জেলা বিএনপিতে সভাপতি করা হয় কাজী মনিরুজ্জামান এবং সাধারাণ সম্পাদক করা হয় অধ্যাপক মামুন মাহমুদকে।
অপরদিকে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট মহানগর বিএনপি’র কমিটিতে সভাপতি করা হয় সাবেক সাংসদ আবুল কালাম এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয় এটিএম কামালকে। দুই কমিটি দেয়ার পরপরই দুটো কমিটিতে নেতৃত্বের লড়াই আর অন্তর্দ্বন্দ্বে সেভাবে কোন সাফল্য অর্জন করে দেখাতে পারে নি।
অবশ্য দুটো কমিটির সবসময়ই সমালোচনা করে আসছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের ৬২ নং উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। অবশ্য সবাই মনে করছেন এদুটো কমিটি দেয়ার পরও বিএনপি ঐক্যবদ্ধ না হতে পারার বড় কারণ হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন প্রত্যাশা। নারায়ণগঞ্জের ৫টি আসনেই বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যে এ প্রতিযোগিতা চরমে উঠেছে বেশ আগে থেকেই।
নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে বিএনপি’র প্রার্থী হিসেবে সবসময়ই সরব রয়েছেন ৩ জন। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক জেলা বিএনপি’র সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার, বর্তমান জেলা বিএনপি’র সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য দিপু ভূইয়া রয়েছেন। তবে তিনজনই যে কোন কর্মসূচী পালনে, সভা-সমাবেশ আয়োজনে এবং বলয় অনুসরন করে চলেন। ফলে এ আসনটির বিএনপি’র তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিভক্ত।
নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে বিএনপি’র প্রাথী হিসেবে সবসময়ই বলয় তৈরী করেছেন সাবেক সাংসদ আতাউর রহমান আঙ্গুর, আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি বদিউজ্জামান খসরু এবং কেন্দ্রীয় বিএনপি’র সহ-আন্তুজার্তিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ। তারা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা ভাবে কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন।
নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনে বিএনপি’র টিকিট পেতে মরিয়া জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আযহারুল ইসলাম মান্নান। তবে হাত পা গুটিয়ে বসে নেই সাবেক সাংসদ রেজাউল করিমও। তবে কর্মসূচিতে এক হতে পারছেন না তারা।
এ আসনটিতে প্রার্থীতা দাবি করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তিনজন কখনোই একমঞ্জে এসে দাঁড়াতে পারেন নি।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ গঠিত । এ আসনে সাবেক সাংসদ ও জেলা বিএনপি’র সদস্য গিয়াস উদ্দীন এবং শাহ্ আলমের সাথে মনোনয়নের টিকিটের দ্বৈরথটি ২০০৮ সাল থেকেই।
দীর্ঘদিন ধরেই তারা দুটি বলয় তৈরী করে যে কোন কর্মসূচি পালন করছেন। তবে তাদের সাথে যুক্ত হয়ে এ আসনে প্রার্থীতা দাবি করতে পারেন জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ। মাস খানেক আগে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন নেয়ার দৌড়ের কারণেই নারায়ণগঞ্জ-৫ (বন্দর-সদর)আসনে মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট আবুল কালাম এবং নাসিক নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থী ও মহানগর বিএনপি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের সাথে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে।
বিএনপি’র যে কোন সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ ও কর্মসূচিও পালন করা হয় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে। ‘কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ । ঐক্যহীনতার কারণে কোন কর্মসূচীতে সাফল্য দেখাতে পারছে না তারা। তবে এ আসনে তৈমূর আলম খন্দকারের ছোট ভাই ও নাসিক ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিরর এবং মহানগর যুবদলের আহবায়ক মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ প্রাথীতা করতে পারেন বলে জনশ্রুতি আছে। বর্তমানে তিনি একাধিক মামলায় গ্রেফতার হযে কারাগারে রয়েছেন।
তবে শুধু মনোনয়ন প্রত্যাশাটিই সমস্যা হিসেবে থেমে থাকে নি। এর প্রভাব পড়েছে বিএনপি’র অঙ্গ-সংগঠনগুলোতেও। সম্প্রতি ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবকদলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ কমিটিতে বলয় হিসেবে করেই সংগঠিত হতে চাচ্ছেন বিএনপি নেতারা। ২৬ জুন ঘোষণা দেয়া হয়েছে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের নতুন কমিটি।
যেখানে সভাপতি হয়েছেন আনোয়ার সায়েম সাদাত এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন মাহবুব রহমান। এদিকে ৬ জুন মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের নতুন কমিটি ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় বিএনপি। যেখানে মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট আবুল কালামের ছেলে আবুল কাউসার আশা হয়েছেন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন সাখাওয়াত হোসেন রানা।
কমিটি ঘোষণার পর বিজয় মিছিল করতে গিয়ে সভাপতি আবুল কাউসার আশা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। স্বেচ্ছাসবক দলের কমিটি ঘোষণার আগে জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। জেলা ছাত্রদলের সভাপতি হিসেবে মশিউর রহমান রনি আর খাইরুল ইসলাম সজীবকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়।
মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি করা হয় শাহেদ আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় মমিনুর রহমান বাবুকে। যুবদলের কমিটিও খুব শীঘ্রই দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিএনপি’র নেতারা।
সম্প্রতি মহানগর বিএনপি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান জানিয়েছেন, মহানগর বিএনপি’র সভাপতি তার বাড়ির ৭ তলা ছেড়ে নামেন না আর সাধারণ সম্পাদক আছেন নাতি-নাতনী নিয়ে আমেরিকায়।
স্বাভাবিকভাবে মহানগর বিএনপি বিপর্যস্ত। তবে আমাদের দল কর্মী নির্ভর। তাদের নিয়েই আমরা কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করে আসছি। সামনের দিকে দলকে আরো সংগঠিত করার কাজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, মনোনয়ন ইস্যুতে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি ক্রমেই এলো মেলো হয়ে যাচ্ছে। মনোনয়ন প্রত্যাশীরা শুধু নিজের নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। মাঠে তাদের অবস্থান চোখে পড়ার মত নয়। এভাবে বিএনপির কার্যক্রম চলতে থাকলে তাদের ঘুড়ে দাড়ানো সম্ভব নয়।