নিজস্ব প্রতিবেদক:
নারীর অর্জিত অর্থে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো হস্তক্ষেপ করার আইনগত কোনো অধিকার বা ক্ষমতা নেই। যেমন আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেন: ‘যা কিছু পুরুষরা অর্জন করবে, তা তাদেরই অংশ হবে; আবার নারীরা যা কিছু উপার্জন করবে, তাদেরই অংশ হবে।’ (সূরা নিসা: ৩২)।
ইসলাম-পূর্বে নারীরা ছিল অত্যন্ত অসহায়। তাদের ব্যাপারে বুদ্ধি ও যুক্তিসঙ্গত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হত না। একমাত্র বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) নারী জাতির প্রকৃত মুক্তি ও স্বাধীনতা দিয়েছেন। দিয়েছেন পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা। মহাগ্রন্থ কোরআনুল কারীম ও হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে ইসলামের গৌরবময়, কালজয়ী নারী মুক্তির সনদ ও সুনিশ্চিত অধিকারের বার্তা। এভাবেই ইসলাম সর্বপ্রথম নারীদের সমাজে স্বাধীন, সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার প্রদান করে, এমনকি সূরা নিসা নামে পবিত্র কোরআনের একটি পূর্ণাঙ্গ সূরাই নাজিল হয়।
আল্লাহ তা’আলা বলেন; ‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার সঙ্গিনী ও তাদের দুইজন থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) বিস্তার করেছেন।’ (সূরা নিসা: ১) এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা নারী ও পুরুষের সৃষ্টি একই উৎস থেকে এবং একই রক্ত-মাংস দ্বারা উভয়ের সৃষ্টি, তা উল্লেখ করেছেন। দৈহিক অবয়ব ব্যতীত সৃষ্টি ও মর্যাদার দিক দিয়ে মূলত নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আল্লাহপাক আরো বলেছেন: ‘তারা (স্ত্রীগণ) তোমাদের পোশাক এবং তোমরা (স্বামীগণ) তাদের পোশাক স্বরূপ।’ (সূরা আল-বাকারা :১৮৭) অর্থাৎ পোশাক ও দেহের মধ্যে যেমন কোনো পর্দা বা আবরণ থাকে না, বরং উভয়ের মধ্যে পরস্পর সম্পর্ক ও মিলন একেবারে অবিচ্ছেদ্য, তদ্রূপ সম্পর্কই তোমাদের ও তোমাদের স্ত্রীগণের মধ্যে বিরাজমান রয়েছে এবং তা থাকা বাঞ্ছনীয়।
নারীর অধিকারের কথা উল্লেখপূর্বক আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন :‘নারীদের (পুরুষদের উপর) তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে যেমনি রয়েছে নারীদের উপর পুরুষদের’ (সূরা আল বাকারা :২২৮) এ আয়াতে যেমনি সুস্পষ্টভাবে নারীদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, অন্য কোনো ধর্মে এভাবে নারীর অধিকারের কথা বলা হয়নি।
নারী-পুরুষের সমতা বিধানের ক্ষেত্রে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন: “ঈমানদার অবস্থায় যে কেউ নেক আমল ও সৎকর্ম সম্পাদন করবে, সে পুরুষ হোক অথবা নারী, তাকে আমি অবশ্যই (দুনিয়ার বুকে) পবিত্র জীবন দান করব এবং পরকালের জীবনেও উক্ত নেক আমলের জন্য উত্তম বিনিময় দান করব।” (সূরা আন-নাহল : ৯৭) এ আয়াতে নারী-পুরুষের সৎকর্মের বিনিময় ইহকাল ও পরকালে সমপরিমাণ পুরস্কার ও বিনিময় দানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। এতে মানবিক অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে সমস্ত মানুষই সমান। এই মহান জীবনাদর্শে পুরুষ বা নারী হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের কোনো মাপকাঠি নির্ণয় করা হয়নি।
আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে যে কন্যা সন্তানকে জীবিত কবর দেওয়া হতো, সেই সন্তানের লালন-পালনকে জান্নাতের উসিলা হিসেবে পেশ করে মহানবী (স) ইরশাদ করেন : “যার তিনটি কন্যা সন্তান অথবা তিনটি বোন বা দুটি কন্যা বা দুটি বোন থাকবে, আর যদি সে তাদের প্রতি যত্নশীল হয় এবং তাদের হক সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় করে, তার জন্য বেহেশত অনিবার্য।” (তিরমিযী ও আবু দাঊদ)। নবী করীম (স) বলেছেন :‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ এ হাদিস দ্বারা রাসূলুল্লাহ (স) নারীর মর্যাদাকে উচ্চ আসনে সমাসীন করেছেন।
ইসলাম নারীকে বিবাহের মত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ও অধিকার প্রদান করেছে। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : ‘প্রাপ্তবয়স্কা নারীকে তার সম্মতি ব্যতীত বিবাহ দেওয়া যাবে না।’ হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, আসমা নাম্নী এক মহিলার স্বামী একটি পুত্র সন্তান রেখে ইন্তেকাল করেন। তখন মহিলার দেবর তাকে বিবাহের জন্য মহিলার পিতার নিকট প্রস্তাব পেশ করে। মহিলাও এ লোকটির সাথে তাকে বিবাহ দেওয়ার জন্য তার পিতাকে অনুরোধ করে। কিন্তু পিতা এতে সম্মত না হয়ে তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপর এক ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ দেন। অতঃপর মহিলা মহানবী (স) এর নিকট আগমন করে ঘটনার বর্ণনা করেন। তিনি মহিলার পিতাকে ডেকে এনে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। লোকটি আরজ করলো, ঘটনা সত্য। তবে আমি তাকে তার দেবরের চেয়ে উত্তম ব্যক্তির নিকট বিবাহ দিয়েছি। (সবকিছু অবগত হয়ে) রাসূলুল্লাহ (স) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে মহিলার ইচ্ছানুযায়ী তার দেবরের সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার জন্য তার পিতাকে নির্দেশ প্রদান করেন। (মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা, হাদিস নং ২৬৭)
ইসলামী বিধান অনুযায়ী তালাকপ্রাপ্তা অথবা বিধবা নারীদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে। এছাড়াও পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর সম্মানকে অর্থবহ করার জন্য রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন : ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম।’ (তিরমিযী) কি সুন্দর শিক্ষা! একজন স্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে স্বামীকে সনদ প্রদানের মর্যাদা। এছাড়া ইসলামে নারীদেরকে দেওয়া হয়েছে সম্পদের মালিকানার অধিকার এবং তা ব্যয় করার অধিকার, ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার, শিক্ষালাভের অধিকার, কর্মক্ষেত্রের অধিকার, কথা বলার অধিকার।
নারী তার পিতা, মাতা, স্বামী, পুত্র, ভাই ও অন্যান্য আত্মীয়ের নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদের মালিক হওয়ার আইনগত অধিকার রাখে। এছাড়া বিবাহের সময় স্বামী প্রদত্ত মোহরানার অর্থসহ যাবতীয় অলঙ্কারের একচ্ছত্র মালিক হলো নারী। এ সমস্ত উত্স থেকে প্রাপ্ত নারীর অর্থ ও সম্পদে স্বামীসহ অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করার আইনগত অধিকার রাখে না। ইসলাম নারীদেরকে অর্থ উপার্জনেরও অধিকার দিয়েছে। চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু নারীর অর্জিত অর্থে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো হস্তক্ষেপ করার আইনগত কোনো অধিকার বা ক্ষমতা নেই। যেমন আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেন : ‘যা কিছু পুরুষরা অর্জন করবে, তা তাদেরই অংশ হবে; আবার নারীরা যা কিছু উপার্জন করবে, তাদেরই অংশ হবে।’ (সূরা নিসা :৩২)