সংবাদচর্চা রিপোর্ট:
আগামী নির্বাচনে যারা নৌকা প্রতীকে প্রার্থী হতে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে এমন বহুজন থাকবেন যারা পূর্ণকালীন রাজনীতিতে জড়িত নন। জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা আর সাকিব আল হাসানের নাম প্রচার হয়ে গেছে এরই মধ্যে। তারা মনোনয়ন ফরম তুলবেন- নিশ্চিত করেছে ক্ষমতাসীন দল। তবে তারা এখনো যেটা জানায়নি সেটা হলো, এ রকম চমক আরও থাকবে।
বেশ কয়েকজন অভিনয়শিল্পীও পেতে পারেন মনোনয়ন। একাধিক বরেণ্য অর্থনীতিবিদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের একাধিক সদস্যও আছেন দলের বিবেচনায়। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে সমাজসেবী হিসেবে পরিচিতদের হাতেও দেয়া হতে পারে নৌকা প্রতীক।
গত দুই মেয়াদে ক্ষমতাসীন দলটি আগামী নির্বাচনকে নিচ্ছে গুরুত্বের সঙ্গে। গত নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট বর্জন করায় যে সহজ জয় এসেছিল, সেটি এবার হবে না, তা নিশ্চিত ধরেই আগাচ্ছে তারা। বরং বিএনপির নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং পুরনো জোট ২০ দলকে একসঙ্গে মোকাবেলা করতে কী করতে হবে, সেটাও ভেবে রেখেছে তারা।
এর অংশ হিসেবেই এমন প্রার্থী বেছে নেয়া হবে যারা একাধারে পরিচিত মুখ, অন্যদিকে জনপ্রিয়, বিতর্কমুক্ত। আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, সাকিব ও মাশরাফিকে প্রার্থী করার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে। তবে ইতিমধ্যে সাকিব আল হাসান জানিয়ে দিয়েছেন তিনি নির্বাচন করবেন না। নিজ এলাকা মাগুরা-১ আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল সাকিবের। অন্যদিকে মাশরাফির জন্য নড়াইল-২ আসন বেছে রেখেছে আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য ঢাকা টাইমসকে বলেন, সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে শেখ হাসিনার ইতিবাচক মনোভাব দেখানোর কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর অন্যতম হলো খেলোয়াড়দের মনোনয়ন দিলে বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চয়তা মিলবে।
দ্বিতীয়ত. ‘তারকা ব্যক্তিদের’ মনোনয়ন দিলে ঢাকাসহ সারাদেশে নির্বাচনী উৎসব বিরাজ করবে বলে তাদের ধারণা। আর এই তারকাদের ভক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারাদেশে। এতে অন্য আসনেও সুফল মিলবে।
সব মিলিয়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তারকা মনোনয়ন দেয়ার সংখ্যাটি ২০ থেকে ২৫ জনও হতে পারে বলেও জানিয়েছেন নেতারা। এদের মধ্যে অবশ্য সবাই নতুন মুখ হবে না।
নির্বাচনে উৎরানোর জন্য তারকাদের দলে টানা নতুন কোনো ঘটনা নয়। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বেশ কয়েকজন অভিনেতা, অভিনেত্রী, শিল্পী, সাবেক খেলোয়াড়কে মনোনয়ন দিয়ে বাজিমাত করেছেন। লাইবেরিয়ায় সাবেক ফুটবলার জর্জ উইয়াহকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দিয়ে জিতে যায় সে দেশের রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেটিক চেঞ্জ।
‘নির্বাচনে আমরা উইনেবল প্রার্থী দেব- যিনি জনপ্রিয়, যিনি উইনেবল-তাকেই বেছে নেব’- কথাটি বারবার বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আর মনোনয়ন ফরম বিক্রির সময়ই কিছু বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ জানিয়ে দিয়েছে আজ মনোনয়ন তুলবেন দুই ক্রিকেট তারকা। সাবেক খেলোয়াড়দের রাজনীতিতে জড়ানো অভিনব কোনো ঘটনা নয়। তবে ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকাকালেই নির্বাচনে নামার বিষয়টি বিরল। আর সেটিই এবার ঘটতে যাচ্ছে।
বাগেরহাট-৩ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন চলচ্চিত্র অভিনেতা শাকিল খান। প্রখ্যাত অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী ফরম নিয়েছেন ফেনী-৩ আসনের জন্য। ৯০ দশকে বাংলা নাটকের তুখোড় অভিনেত্রী শমী কায়সারও ফেনী-২ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম কিনতে পারেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারাই।
আরও চমক হয়ে আসছেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস। তিনি মনোনয়ন ফরম কিনতে যাচ্ছেন যশোর-৩ আসন থেকে। এ আসনে তার শ্বশুর আলী রিয়াজ রাজু আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। বিএনপিপন্থী অভিনেতা হিসেবে পরিচিত মনোয়ার হোসেন ডিপজল এরই মধ্যে ঢাকা-১৪ আসন থেকে ফরম নিয়েছেন। নাট্যব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুসও মনোনয়ন ফরম কিনতে পারেন নোয়াখালী-১ আসন থেকে। ম. হামিদ নিতে পারেন একটি আসন থেকে।
অভিনেত্রী এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যের পরিচয় ঘুচিয়ে সরাসরি নির্বাচনে নামতে চান। তিনি মনোনয়ন ফরম কিনেছেন টাঙ্গাইল-৬ আসনের জন্য। নাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমান ফরম নিয়েছেন টাঙ্গাইল-১ আসন থেকে।
কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমকে মানিকগঞ্জ-২ আসন প্রার্থী করে ২০০৮ সালেই সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য করে চমকে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালে তাকে সরাসরি প্রার্থী করা হয়। তবে ভোটের লড়াইয়ে নামতে হয়নি তাকে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যান তিনি। তবে এবার তিনি সরাসরি ভোটের প্রতিযোগিতায় নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ফরাসউদ্দিন আহমেদকে অর্থনীতির তারকা বললে অত্যুক্তি হয় না। তিনি ফরম নিয়েছেন হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে। পাবনা-৫ আসন থেকেও একজন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদকে প্রার্থী হিসেবে রাজি করার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন দল। তিনি নাগরিক সমাজের সদস্য হিসেবেও পরিচিত।
বাংলাদেশেও তারকারা নানা সময় ভোটে নেমে ভালো করেছেন। জামায়াতের শক্তিশালী ঘাঁটি নিজের করে ফেলেছেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ২০০১ সালে সারাদেশে দলের বিপর্যয়ের মধ্যেও নীলফামারী-২ আসন থেকে জেতেন তিনি। পরের নির্বাচনে ব্যবধান বাড়ান আরও বেশি।
বাংলাদেশ ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আরিফ খান জয় ২০০৮ সালে নেত্রকোণা-২ আসন থেকে বিপুল ব্যবধানে সংসদ সদস্য হন। বর্তমান তিনি যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী। এবারও তিনি এই আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে সারাহ কবরী ২০০৮ সালে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে দশম সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। আর এবার তিনি ফরম তুলেছেন ঢাকা-১৭ আসনের জন্য।
বাংলাদেশ টেস্ট দলের প্রথম অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয় ২০১৪ সালে মানিকগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচিত হন সরাসরি ভোটে। এবারও তাকে ওই আসনটি দেয়ার বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান বলেন, ‘ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন পেশায় যারা নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছেন, তাদের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।’
‘বরাবরই আমরা তারকাদের দলীয় মনোনয়ন দিয়ে থাকি। অতীতের নির্বাচনেও এটা হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়।’