আজ রবিবার, ২১শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আয় চল না’গঞ্জ-খেলা হবে বদমাইশ!

সংবাদচর্চা রিপোর্ট:

নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক নেতাদের বাকযুদ্ধে কাঁপছে পুরো নারায়ণগঞ্জ। হুমকি-পাল্টা হুমকি, কটু কথায় যে যাকে, যেভাবে পারছে ছোট করার খেলায় মেতে উঠেছে। এতে যেমন করে নিজেদের ইমেজ ক্ষুন্ন হচ্ছে, তেমনি নারায়ণগঞ্জের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে বলে জানান রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

আয় চল নারায়ণগঞ্জ, গড ফাদার, খেলা হবে শুনলেই দেশবাসী নারায়ণগঞ্জের দিকে আঙ্গুল তুলে দেন।

জানা যায়, যেখানে উৎসব মুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। যেখানে নারায়ণগঞ্জে নির্বাচন আসলেই নেতায় নেতায় শুরু হয় দ্বন্দ্ব, শুরু হয় বাকযুদ্ধ। কে কাকে কতটা ছোট করে কথা বলতে পারে তা নিয়ে চলে তুমুল প্রতিযোগীতা। আর এই বাকযুদ্ধ নিয়ে চলে পুরো বাংলাদেশে আলোচনা সমালোচনা।

ঘটনা সূত্রে প্রকাশ, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিন হায়াৎ আইভীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব বিরোধ উত্তরাধিকার সূত্র ধরেই। তাদের পূর্ব পুরুষদের বিরোধ এসে বর্তায় এই দুইজনের উপর। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে দুইজনের প্রতিন্দ্বন্দ্বীতার পর সেই বিরোধ প্রকট আকারে রূপ নেয়। সেটার জের ধরে আগে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ, মানববন্ধন, কেন্দ্রে নালিশ সহ তির্যক বাক্য বিনিময় হলেও কখনো সংঘর্ষে রূপ নেয়নি। তবে পরবর্তিতে হকার ইস্যুতে দুই গ্রুপের প্রকাশ্যে সংঘর্ষ ও রাস্তায় নামার বিষয়টিকে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বড় ধরনের অশনি সংকেত মনে করছেন স্থানীয় রাজনীতিকেরা।

নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর মধ্যকার একটি বাকবিতন্ডা ছিল বছরের আলোচিত ‘ঝগড়া’। বেসরকারী টিভি চ্যানেল একাত্তর একটি টক শো অনুষ্ঠানে এ দুইজন আলোচিত ব্যক্তিত্ব তুমুল বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। দুইজনই উত্তেজিত হয়ে উঠেন যাঁর মধ্যে মেয়র আইভীকে কয়েকবার চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে দেখা যায়। টকশোতে তাদের এমন বাকবিতন্ডার খবর এখন দেশজুড়ে মানুষের রসালো আলোচনার খোরাক হয়ে উঠেছিল।

একাত্তর টিভি চ্যানেলের টক শো অনুষ্ঠানে অংশ নেন শামীম ওসমান, সেলিনা হায়াত আইভী ও সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোর্তজা। সঞ্চালনায় ছিলেন একাত্তর টিভির আউটপুট এডিটর শাকিল আহমেদ। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডারের প্রসঙ্গ নিয়ে ওই আলোচনার শুরু থেকে শেষ অবধি শামীম ওসমান ও আইভীর মধ্যকার তুমুল বাকবিতন্ডার ঘটনা ঘটে। তবে বিরতির সময়ে সেই বিতন্ডা থেকে হাতাহাতির পর্যায় পর্যন্তও গড়ায়। এনিয়ে শুরু হয় তোলপাড়।

একজন বললেন, ‘তুই নারায়ণগঞ্জে চল, তোরে দেখাইতেছি।’ সঙ্গে সঙ্গে অপরজনের জবাব, ‘চল নারায়ণগঞ্জ, কি করবি?’

প্রথমেই আক্রমণে যান মেয়র আইভী। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের গডফাদার একজনই সেটা এ কে এম শামীম ওসমান এবং তার সৃষ্টি আরও কিছু গডফাদার। নূর হোসেনকে প্রথমে গণমাধ্যমের সঙ্গে কেন কথা বলতে দেওয়া হলো না? গণমাধ্যমকে ফেস করল কে? নজরুলের মৃত্যুর পরও যখন সংসদ সদস্য শামীম ওসমান সাহেব ওখানে গিয়ে বক্তৃতা করলেন তখন উনিই বললেন, নূর হোসেনই হত্যাকান্ডে জড়িত। তার পরদিনই উনি টেলিফোনে বলছেন, ‘তুমি চলে যাও’। তাহলে গডফাদার বলাটা তো আমার ভুল হয়নি। আমি আমার অবস্থানে অনড়। আইভীর এমন বক্তব্যের জবাবে শামীম ওসমান বলেন, সে গডফাদার মিন করেছে শামীম ওসমানকে। এটা ওর মিনিংয়ের ব্যাপার না। যাকে আমি দেখি করাপশনের একজন নায়িকা হিসেবে তার ব্যাকগ্রাউন্ড, তার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সবকিছু মিলে তার প্রশ্নের উত্তর আমি সরাসরি তাকে অ্যাটাক করতে চাই না। এটা আমার রুচিতে বাধা দেয়। প্রতিটা জিনিসের একটা সৌজন্যতা, একটা ভদ্রতা, কথা বলার স্টাইল- সবকিছুর মধ্যে একটা মানুষের পরিচয় পাওয়া যায়।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জের আলোচিত মেধাবী ছাত্র ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির পুত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকান্ড নিয়ে সিটি মেয়র আইভী ও শামীম ওসমানের মধ্যকার বিরোধ তুঙ্গে উঠে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের বছর জুড়েই ত্বকী হত্যাকান্ডকে নিয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচীতে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করে নারায়ণগঞ্জ নগরীতে।

তবে ওই ঘটনার পরে দীর্ঘদিন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের বিদ্যমান বিরোধ বাকযুদ্ধেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেলে পাল্টে যেতে থাকে নারায়ণগঞ্জের দৃশ্যপট। ওই নির্বাচনের আগে শামীম ওসমান আইভীকে সমর্থন জানিয়ে তার পক্ষে কাজ করা ছাড়াও আইভীকে ভোট দিয়ে প্রকাশ্য ব্যালটে সিল মারেন। গত সিটি নির্বাচনের পর থেকে একেবারেই থেমে ছিল আইভী ও শামীম ওসমানের মধ্যকার প্রকাশ্যে বৈরিতা।

গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে শহরে কড়াভাবে হকার উচ্ছেদ অভিযান চালায় সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশ। এর পর থেকে হকাররা নিয়মিত আন্দোলন করে আসলেও আইভী কোনভাবেই হকার শহরে বসতে না দেওয়ার ঘোষণা দেন। এর মধ্যে গত ৯ জানুয়ারী সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব গ্রহণের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে সেলিনা হায়াৎ আইভী অভিযোগ করেন শামীম ওসমান তার ছেলের বিয়েতে ২৫ কোটি টাকা খরচ করেছে। আর এখন তিনি হকারদের জন্য মায়াকান্না করছে। এ নিয়েও চলে দুজনের মধ্যে তুমুল বাকযুদ্ধ।

মেধাবী ছাত্র ত্বকি হত্যা কান্ড নিয়ে পাল্টা পাল্টি এক সমাবেশে বিএনপি, জামায়াত, খালেদা জিয়া নিয়ে আয় আমরা খেলবো। খেলা হবে এমন বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জ সহ পুরো বাংলাদেশে সমালোচনা হয়। নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয় এমন বক্তব্য।

পরবর্তীতে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে  জাতীয় পার্টির সাংসদ ও প্রার্থী সেলিম ওসমানের সাথে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী এস এম আকরামের পাল্টাপাল্টি সমালোচনার মধ্য দিয়ে চরম বাকযুদ্ধের ঘটনা দেখা গেছে।

২৩ ডিসেম্বর এক সভায় ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী এসএম আকরামকে ইঙ্গিত করে সেলিম ওসমান বলেন, ‘আপনারা জানেন আমার সাথে যিনি নির্বাচন করছেন তিনি এক সময় আওয়ামীলীগের জেলা প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেখান থেকে টিকেট নিয়ে নৌকার এমপিও হয়েছিলেন। তারপর তিনি হঠাৎ করেই নৌকাকে ছেড়ে দিলেন। তার নৌকা ডুবে গেলো। ডুবে গেলো এই কারণে যে তাকে নিয়ে জনগণের অসন্তোষ ছিল যে তিনি অনেকটা সময় উত্তরা ক্লাবে জুয়ার টেবিলে থাকতেন। তারপর তিনি একটা আনারস কিনে এসে আমার সাথে উপ-নির্বাচন করলেন। এতো বেশি ফরমালিন দিয়েছে সেটা পঁচে গেছে। এবার গিয়ে এই আওয়ামী লীগের নেতা ডক্টর কামাল হোসেনের লেজ ধরে কোনো রকমে গিয়ে ধানের শীষ নিলেন। এটা কখনও খালেদা জিয়ার ধানের শীষ নয়। এটা চিটা ধান। সে জন্যেই বিএনপির অনেক নেতা আমাকে সাহায্য করেছেন।

অন্যদিকে ঐদিন এক পথসভায় আকরাম বলেন, আজকের পত্রিকা দেখলাম আমার প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী (সেলিম ওসমান) বলেছেন, কলিজা ছিড়ে ফেলবে। এখনই “জনগণের কলিজা ছিড়ে ফিলবে” তাহলে পাশ করলে কি করবে কে জানে? এই প্রার্থীকে আবার ভোট দিবে কে? এমন ভাষা যারা ব্যবহার করে জনগনের কলিজা ছিড়ে নেবে তাদের ভোট দেবে কেন? তাদেরকে কি ভোট দেয়া উচিত।

সর্বশেষ, বন্দর উপজেলা নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী এমএ রশিদের মনোনয়ন পত্র জমা দিতে উপজেলায় যান শামীম ওসমান। সেখানে গিয়ে বক্তব্যে উশৃঙ্খল কথা বলেও আলোচনার সৃষ্টি করেছেন এই সংসদ সদস্য। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন, বদমাইশের হাত থেকে বন্দর রক্ষা করতে রশীদ ভাইরে আনছি। ‘বন্দর উপজেলার অনেকেই মানসিকভাবে অস্বস্তিতে ছিলেন, বন্দর কি কোন খারাপ লোক, বদমাইশের হাতে পড়ছে কিনা, এরকম চিন্তা অনেকের ছিল। অনেকেই অনেক তদবির করেছেন, আমরা সবাইকে নিয়েই কাজ করবো। বন্দর উপজেলা নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন আইভী বলয়ের-জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সুফিয়ান, মদনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালাম। শামীম ওসমান বদমাইশ বলে কাকে ইঙ্গিত করছে তা নারায়ণগঞ্জবাসী জানা হলেও চলছে নানা আলোচনা।

রাজনীতিবিদদের বেফাস মন্তব্য আর বাকযুদ্ধে প্রায় সময় হতভাগ হয়ে যায় নগরবাসী। অস্থির হয়ে উঠে রাজনীতির মাঠ। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ হয়ে উঠে অস্থিতিশীল। বেফাঁস মন্তব্য পেশী শক্তির চেয়েও বেশি শক্তিশালী বলেই মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা।