নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে । বিকেল ৩টায় শুরু হতে যাচ্ছে প্রথম অধিবেশন। রেওয়াজ অনুযায়ী এই অধিবেশনে ভাষণ দেবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এর আগে নতুন সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করা হবে। দশম সংসদের বিদায়ী স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তৃতীয় মেয়াদে স্পিকার পদে এবং ডেপুটি স্পিকার পদে নওগাঁ-২ আসনের এমপি শহীদুজ্জামান সরকার নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ ও সংসদ সচিবালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এরই মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন শেখ হাসিনা। তবে সংসদ উপনেতা, সংসদের চিফ হুইপ ও হুইপ পদে এখনও কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যদিও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে তার ভাই জিএম কাদের এবং বিরোধীদলীয় হুইপ পদে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ নিয়োগ পেয়েছেন।
নতুন সংসদের চিফ হুইপ পদে মাদারীপুর-১ আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ নূর-ই আলম চৌধুরী লিটনের নাম অনেকটাই নিশ্চিত। এর আগে তিনি হুইপের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়াও হুইপ পদে দশম সংসদের হুইপ দিনাজপুর-৩ আসনের এমপি ইকবালুর রহিম ও শেরপুর-১ আসনের এমপি আতিউর রহমান আতিকের পাশাপাশি নতুন হুইপ হিসেবে আসছেন খুলনা-১ আসনের এমপি পঞ্চানন বিশ্বাস এবং চট্টগ্রাম-১২ আসনের এমপি শামসুল হক চৌধুরী।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, বিদায়ী ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়ার সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হবে। কোরআন তেলাওয়াতের পর তিনি স্বাগত ভাষণ দেবেন। এরপর নতুন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করা হবে। তারপর ডেপুটি স্পিকার বিদায়ী ভাষণ দেবেন। এ পর্যায়ে সংসদের অধিবেশনে সাময়িক বিরতি দেওয়া হবে।
বিরতির সময় নবনির্বাচিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার শপথ গ্রহণ করবেন। সংসদ ভবনের সপ্তম তলায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নবনির্বাচিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারকে শপথ পড়াবেন। বিরতি শেষে বৈঠকের শুরু হলে নতুন স্পিকার স্বাগত ভাষণ দেবেন। পরে নতুন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য দেবেন সাংসদরা। এরপর স্পিকারের অনুপস্থিতিতে সংসদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করার জন্য সভাপতিমণ্ডলী মনোনয়ন দেওয়ার কাজ শেষে সংসদের অধিবেশন না থাকার সময় সরকারের জারিকৃত বেশ কয়েকটি অধ্যাদেশ উপস্থাপন করা হবে।
এ পর্যায়ে শোক প্রস্তাব গ্রহণ, আলোচনা ও মোনাজাতের পর আবারও বিরতি দেওয়া হবে। চলমান সংসদের কোনো সদস্য মারা গেলে শোক প্রস্তাবের আলোচনা শেষে অধিবেশন মুলতবির রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচিত হলেও শপথ নেওয়ার আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাই একাদশ সংসদের এমপি হিসেবে তাকে গণ্য করা হচ্ছে না। তবুও তার প্রতি সম্মান জানিয়ে এ পর্যায়ে সংসদের বৈঠক আবারও মুলতবি করা হবে।
তবে রাষ্ট্রপতির ভাষণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে কিছু সময়ের জন্য অধিবেশন মুলতবির পরে আবারও শুরু হবে এবং রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ভাষণ দেবেন। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর আজকের মতো অধিবেশন মুলতবি হয়ে যাবে। পরে অধিবেশনজুড়ে এ ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনা করবেন সংসদ সদস্যরা।
বিশ্নেষকরা মনে করছেন, এই সংসদ কতটা প্রাণবন্ত ও কার্যকর হবে তার অনেকটাই নির্ভর করছে বিরোধী দলের ভূমিকার ওপর। সরকারের কাজের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠাই হবে এই সংসদের মূল চ্যালেঞ্জ। গত ৯ জানুয়ারি একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেন রাষ্ট্রপতি। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পায় আওয়ামী লীগ। ২৯৯ আসনের মধ্যে ২৫৭টিতে জয় পেয়েছে তারা। জোটগতভাবে পেয়েছে ২৮৮ আসন। অন্যদিকে নির্বাচনে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ও তাদের জোটসঙ্গীরা সব মিলিয়ে মাত্র আটটি আসন পেয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটসঙ্গী দলগুলোর নির্বাচিতরা গত ৩ জানুয়ারি সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন। নিয়ম অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে প্রথম অধিবেশন বসার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এদিকে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করা বিএনপি জোটের নির্বাচিতরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঐক্যফ্রন্টের বিজয়ীদের শপথ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তার কাছে কোনো তথ্য নেই। নিয়ম অনুযায়ী তারা শপথ না নিলে ৯০ দিন পরে এ বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত জানাবেন।
এদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিলেও সংসদের বিরোধী দলের আসনে বসতে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। দশম সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার আসনে ছিলেন রওশন এরশাদ। এবার তার পরিবর্তে দলের চেয়ারম্যান এরশাদ নিজেই এই পদে বসছেন। গতবার বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রিসভায়ও ছিল জাতীয় পার্টি। তবে এবার জাতীয় পার্টি বা আওয়ামী লীগের অন্য শরিকদের কেউই এখন পর্যন্ত সরকারে নেই।
নতুন সংসদকে ঘিরে জনগণের প্রত্যাশা সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবির) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল প্রতিষ্ঠান সংসদ। জনগণ একটা প্রাণবন্ত ও কার্যকর সংসদ দেখতে চায়- যে সংসদ সরকারের কাজের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সরকারের ভুলত্রুটি চিহ্নিত করে তার সমালোচনা করতে পারবে।
এবারের নির্বাচনে ২২ আসনে জিতে বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে বিরোধী দলকে। যদিও তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন সরকারের অংশ হওয়ার আশায়। কিন্তু অনাগ্রহের সঙ্গে তাদের এই দায়িত্ব নিতে হয়েছে। এখন তারা কতটা সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়।
সংসদকে আরও বেশি প্রাণবন্ত ও কার্যকর করতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই অনুচ্ছেদ সংশোধন করে আস্থা ভোট ও বাজেট পাস ছাড়া সংসদের অন্যসব কাজে সরকারি দলের সদস্যদের স্বাধীনতা দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এই অনুচ্ছেদ সরকারি দলের সদস্যদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করে রেখেছে। এটা সম্ভব হলে কার্যকর ও প্রাণবন্ত সংসদের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তবে এই সংসদ নিয়ে জনগণ খুব বেশি আশাবাদী হবে বলেও তিনি মনে করেন না।
গত ৩ জানুয়ারি একাদশ সংসদের বিজয়ীরা শপথ গ্রহণের পর দশম সংসদের কার্যকারিতা নেই বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদরা। যদিও ২৮ জানুয়ারি শেষ হয়েছে দশম জাতীয় সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ।
এদিকে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর সংসদের অধিবেশন চলাকালে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংসদবিষয়ক কাজে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রীদের দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সোমবার এ-সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যে কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক এবং তার অনুপস্থিতিতে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সংসদে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রশ্নোত্তর এবং সংসদ সম্পর্কিত কাজের দায়িত্ব পালন করবেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক নিজের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্ব পালন করবেন। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক নিজের মন্ত্রণালয় ছাড়াও নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদ কার্যক্রমের দায়িত্ব পালন করবেন।