সংবাদচর্চা ডেস্ক : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী গোলাম দস্তগীর। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে।
গোলাম দস্তগীর গাজীর বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলায রুপগঞ্জ থানার রূপসি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম গোলাম কিবরিয়া গাজী এবং মায়ের নাম সামসুননেছা বেগম। তাঁর স্ত্রীর নাম হাসিনা গাজী। তাঁদের দুই ছেলে।
ছোটবেলা থেকেই খুবই চঞ্চল প্রকৃতির ছিলেন গাজী গোলাম দস্তগির, তাই বাবা মার খুবই আদরের সন্তান ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের কথা, তখন তিনি ছাত্র ছিলেন । দেশ তখন ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। ৭ ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষনে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যুদ্ধের কথা । ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনি হত্যাকান্ড চালালো সারা ঢাকা জুড়ে। এর পরই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো সারা বাংলাদেশে।সমস্ত বাংলাদেশ এর মানুষ ছোটাছুটি করতে লাগল নিরাপদ আশ্রয়ের খোজে, কেউ চলে গেলো ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে। ঠিক তখনই বেশকিছু মানুষ স্রোতের বিপরিতে ছিলেন ,স্বপ্ন দেখিছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের ,তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গাজী গোলাম দস্তগীর।
সে সময় সমরাস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান ভারতে। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকা শহরে ফিরে আসেন । বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। অপারেশনে তিনি অগ্রভাগে থাকতেন। গ্যানিজ ও দাউদ পেট্রল পাম্প উল্লেখযোগ্য অপারেশন।
১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা উপদলে বিভক্ত হয়ে ঢাকায় একযোগে কয়েকটি অপারেশন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁরা অবদান রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে থেকে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন জনকে তাঁদের অবদানের ভিত্তিতে বীর শ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করেন। বীর প্রতীক চতুর্থ সর্বোচ্চ উপাধি। মোট ৪২৬ জনকে এই উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
কথা ছিল সন্ধ্যা সাতটায় একটি ফিয়াট গাড়িতে চড়ে গোলাম দস্তগীর গাজী ও তাঁর সহযোদ্ধারা অপারেশনে যাবেন। কিন্তু যাত্রার আগে হঠাৎ ওই গাড়ি বিগড়ে যায়। রাত আটটা পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষা করেন। গাড়ি ঠিক হয়নি। এতে দমে যাননি তাঁরা, বিস্ফোরক রেক্সিনের ব্যাগে ভরে তাঁরা গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে পড়েন। রামপুরায় মঞ্জুর নামে একজনের বাড়ি ছিল তাঁদের আরভি।
ঠিক তখনই তাঁরা শুনতে পান দূর থেকে ভেসে আসা গুলির শব্দ। এতে এলাকার লোকজন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। দ্রুত যে যার বাড়ির বাতি নিভিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন। রাস্তায় চলাচলরত মানুষজন দ্রুত তাঁদের গন্তব্যে যেতে থাকেন। এর মধ্যেই তিনটি ভাড়া রিকশায় উঠে পড়েন তাঁরা। প্রথম রিকশায় গাজী ও নীলু। তাঁদের পায়ের আড়ালে ভাঁজ করে লুকানো ছিল স্টেনগান।
রামপুরা ডিআইটি সড়ক থেকে রিকশা রওনা হয় উলনের পথে। রাস্তায় আলো নেই। অসমান কাঁচা রাস্তায় রিকশা এগিয়ে যায়। সামনের কিছু দূর যাওয়ার পর গাজী ও নীলু পেছনে তাকিয়ে দেখেন বাকি দুই রিকশা নেই। নানা ঘটনার পর তাঁরা আবার একত্র হয়ে রওনা হন। একসময় দৃষ্টিগোচর হয় লক্ষ্যস্থল উলন বিদ্যুৎকেন্দ্রের (সাবস্টেশন) আলো।রওনা হওয়ার সময় তাঁরা ঠিক করে রেখেছিলেন লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি যাওয়ার পর প্রথম রিকশা আগে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফটকে যাবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রিকশায় থাকা মুক্তিযোদ্ধারা ফটকের কাছাকাছি পৌঁছে চালককে দাঁড়াতে বলবেন। চালকেরা তাঁদের চালাকি বুঝতে পারেননি বা কাউকে চিনতেও পারেননি। প্রথম রিকশা আগে ফটকের সামনে যায়।ফটকে তখন পাহারায় ছিল একজন রাইফেলধারী পুলিশ ও বিদ্যুকেন্দ্রের একজন নিরাপত্তাপ্রহরী। তারা দুজন রিকশা দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। গোলাম দস্তগীর গাজী ও নীলু ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চলন্ত রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে চোখের পলকে তাদের দিকে স্টেনগান তাক করে ধরেন। তারপর নিচু গলায় গাজী বলেন, ‘হ্যান্ডসআপস, খবরদার চেঁচামেচি করবে না।’
পুলিশ রাইফেল মাটিতে ফেলে নিঃশব্দে হাত তোলে। নিরাপত্তাপ্রহরী পালানোর চেষ্টা করে। তাকে নীলু আটকান। গাজী বলেন, গেট খুলে দিতে। তাঁর নির্দেশে পুলিশ গেট খুলে দেয়। এর মধ্যে তাঁদের পেছনের সহযোদ্ধারা কাজ শুরু করে দেন। দ্বিতীয় রিকশায় থাকা মতিন (দুই) টেলিফোনের তার কেটে দেন।
গাজী ফটকের পুলিশের কাছে জেনে নেন বাকি পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মীরা কে কোথায়। সে জানায় ১৫-১৬ জন পুলিশ ও নিরাপত্তা-কর্মী একটি বড় ঘরে রাতের খাবার খাচ্ছে। তাদের সবাইকে তাঁরা নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করান। তাদের নিরস্ত্র করে নীলু ও মতিন (দুই) পাহারায় থাকেন। গাজী ও মতিন (এক) স্টেনগান হাতে এগিয়ে যান ট্রান্সফরমারের দিকে।
ট্রান্সফরমার ছিল কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা। প্রায় দোতলাসমান উঁচু ট্রান্সফরমার। অপারেটর রুমের ভেতর দিয়ে সেখানে যেতে হতো। গাজী, মতিন (এক) ও আরও দুই সহযোদ্ধা ভেতরে ঢুকে ট্রান্সফরমারের গায়ে পিকে (বিস্ফোরক) লাগান।
এর আগে তাঁরা পরীক্ষা করে নেন সেটি বিদ্যুতায়িত করা কি না।
সেদিন ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা উপদলে বিভক্ত হয়ে ঢাকায় একযোগে কয়েকটি অপারেশন করেন। গোলাম দস্তগীর গাজীরা বিস্ফোরক লাগানোর কয়েক মিনিট পর দেখা যায়, বিদ্যুৎ চমকের মতো এক ঝলক আলো। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা রামপুরা এলাকা। তারপর নিকষ কালো অন্ধকারে আকাশে ফণা তুলে দাঁড়ায় আগুনের লেলিহান শিখা। ট্রান্সফরমার পুরোপুরি ধ্বংস ও ঢাকা শহরের একাংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
এভাবেই নিজের জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধ করেন দেশকে স্বাধীন করার জন্য।এরপর ঢাকার অপারেশন শেষে ফিরে আসেন রুপগঞ্জের ইছাপুরায় । এখানেও একইভাবে শত্রু মোকাবেলায় ঝাপিয়ে পড়েন অস্ত্র হাতে, রুপগঞ্জকে মুক্ত করেন পাকিস্তান হানাদার বাহীনি থেকে।