আজ শুক্রবার, ৭ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সোনারগাঁয়ে চিকিৎসক সঙ্কট

সোনারগাঁ প্রতিনিধিঃ অনিয়ম, অবহেলায় ও চিকিৎসক সঙ্কটে চলছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবা। ডাক্তার সঙ্কট ও প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ না থাকায় মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে সাধারন রোগীসহ এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চিকিৎসা নিতে আসা গর্ভবতি মা ও শিশুরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, ৫০ শয্যা বিশিষ্ট সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে  প্রয়োজন মত জনবল না থাকা এবং সরকারী নিয়োগ প্রাপ্ত ডাক্তারদের দাম্ভিকতায় অনিয়ম ও অবহেলার কারনে সঠিক চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেনা সাধারন রোগীসহ মা ও শিশুরা। খাতা কলমে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২১ জন চিকিৎসক পদ থাকলেও মাত্র ৬ জন ডাক্তার রোগীদের দেখাশোনা করে থাকেন। এছাড়া বর্তমানে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫ জন ডাক্তারের পদ শূন্য রয়েছে। দৈনিক ঔষদ সরবরাহের তালিকায় রোগীদের মোট ২৩ প্রকারের ঔষদ দেওয়ার বিধান থাকলেও প্যারাসিটামল, এর্ন্টাসিট, হিস্টাসিন, আয়রন, এমোক্সোসিলিন ও জ্বর ঠান্ডা, আমাশয়, ডায়রিয়ার ঔষধ ছাড়া আর কোন ঔষধই দেওয়া হয় না। এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অভিযোগ, বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে হাসপাতালের ডাক্তারদের সখ্যতা থাকায় কমিশনের বিনিময়ে তাদের ঔষধ পেসক্রিপশনে লিপিবদ্ধ করে থাকেন যার ফলে ফার্মেসী মালিকরা অবৈধ ভাবে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। তাছাড়া কিছু ডাক্তারদের রয়েছে নিজস্ব ফার্মেসি ও ক্লিনিক ব্যবসা। পাশাপাশি এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে  ডাক্তারেরা বেশির ভাগ সময় স্থানীয় বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়মিত রোগী দেখা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে  ভেতরে সাড়িবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে থাকা ৭টি এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ব্যক্তি মালিকাধীন। সরকারি ভাবে রোগীদের জন্য দুটি এ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু থাকলেও নিয়োগ প্রাপ্ত চালক গাড়ী বিকল হওয়াসহ নানান অযুহাত দেখিয়ে প্রাইভেট এ্যাম্বুলেন্স দিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী পাঠান। এতে তিনি প্রাইভেট এ্যাম্বুলেন্স মালিকদের কাছ থেকে কমিশন হিসেবে পকেট ভারী করে থাকেন। এছাড়া দৈনিক খাদ্য তালিকায় রোগীদের জন্য উন্নতমানের অনেক প্রকারের খাবার সরবরাহের বিধান থাকলেও প্রতিদিন ভর্তি হওয়া রোগীদের দেওয়া হচ্ছে মাত্র দুচারটি পুরাতন তালিকায় সীমবদ্ধ খুবই নিম্নমানের খাবার। আরো পড়ুন:নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে জুয়া বন্ধে রায় ৯ ফেব্রুয়ারি

বুধবার সকাল ১০ টায় সরেজমিন সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতাল টিকিট কাউন্টারের সামনে অর্ধশতাধিক নারী পুরুষ লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকলেও অধিকাংশ ডাক্তার, নার্স ও স্টাফরা ছিলেন অনুপস্থিত। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসতে থাকেন ডাক্তার, নার্স ও স্টাফরা। সকাল ১১ টায় নাস্তা খাওয়ার অযুহাতে এক দেড় ঘন্টা যাবৎ ডাক্তাররা একটি রোমে বসে আড্ডা করছে, বাহিরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষমান ৭/৮ মাসের শিশুদের কোলে নিয়ে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার আসায় বসে আছেন মায়েরা। তবে হাসপাতালের সামনে অপেক্ষমান রোগীর চেয়ে বিভিন্ন ঔষদ কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধিদের উপস্থিতি বেশী লক্ষ করা যায়। পরে দুপুর ২টা পর্যন্ত হাসাপাতালে অবস্থান করে ভূক্তভোগি রোগী ও সাধারন মানুষের সঙ্গে আলাপ কালে বিভিন্ন অনিয়ম, দূর্নীতি ও ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরেন তারা।
উপজেলার আনন্দবাজার এলাকার সাদিয়া আক্তার বলেন, আমার সন্তান শিশু ইমরান (১০মাস) কে নিয়ে এক ঘন্টা যাবৎ বসে আছি। কোন ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছেনা। চরাঞ্চল নুনেরটেক এলাকা থেকে আসা জমিলা বেগম নামে একজন মা বলেন, আমার শিশুকন্যা অনিকা বয়স (৯মাস) তাকে নিয়ে এসে প্রায় আধঘন্টা হবে বসে আছি চিকিৎসার জন্য ডাক্তার পাচ্ছিনা। তাদের অভিযোগ ডাক্তাররা নিয়মিত না থাকায় চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে গর্ভবতী মায়েরা। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ পলাশ কুমার সাহা তিনি নিজেও ঠিকমত কার্যলয়ে থাকেনা অফিস চলাকালীন বেশির ভাগ সময় মিটিং করার অযুহাতে বাহিরে থাকেন। ওয়ার্ডবয়দের দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা, টিকেট বিক্রিসহ বিভিন্ন অফিসিয়াল কার্যক্রম চলছে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে । আরো অভিযোগ রয়েছে ডাঃ পলাশ কুমার সাহার অনুপস্থিতে জুনিয়র কনসালন্টেন্ড রোগীদের যথার্থ চিকিৎসা সেবা প্রদান না করে দালালদের ধরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন স্থানীয় বিভিন্ন ক্লিনিকে। এসব ডাক্তারদের প্রধান টার্গেট থাকে গর্ভবর্তী মহিলাদের ওপর। চুক্তি ভিত্তিক তাদের গর্ভপাত ঘটানো এবং ক্লিনিকে নিয়ে অপ্রয়োজনীয় সিজার অপারেশনের ব্যবস্থা করা। দুপুর বারটার পর কোন ডাক্তারকেই পাওয়া যায়না। বেশির ভাগ ডাক্তার ঠিকমত অফিসে আসেনা। এছাড়া কিছু ডাক্তারের রয়েছে নিজস্ব ক্লিনিক ব্যবসা, এক শ্রেণীর দালাল চক্র কমিশনের ভিত্তিতে বিভিন্ন পরীক্ষা করার জন্য পাঠিয়েদেন নিজেদের ক্লিনিকে।
স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগ, রোগীদের খাদ্য তালিকায় সপ্তাহব্যাপী অনেক প্রকারের উন্নত খাদ্য সরবরাহের তালিকা থাকলেও ডিম, পাউরুটি, কলা, বয়লার মুরগী ও মোটা চাউলের ভাতসহ মাত্র কয়েকটি খুবই নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করে হাসপাতালে খাবার সরবরাহকারী কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের অভিযোগ প্রতিদিন পচা দূর্গন্ধযুক্ত মোটা চাউলের ভাত দেওয়া হয় এগুলো খাওয়া যায় না। বাধ্য হয়েই বাহির থেকে অন্য খাবার কিনে খেতে হয়। হাসপাতালের রান্না ঘরে গিয়ে দেখা যায় ২০১৬/১৭ সালের পুরাতন খাবার তালিকা অনুযায়ী এখনও রোগীদের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। খাদ্য তালিকা তদারকির করার যেন কেউ নেই।

এব্যাপারে  উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ পলাশ কুমার সাহা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫টি চিকিৎসক পদ শূণ্য রয়েছে। প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় সেই জন্য চিকিৎসাসেবা কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। জানতে চাইলে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবহেলার বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।

নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মোহাম্মদ ইমতিয়াজ আহাম্মেদ জানান, সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক পদ শূন্য থাকার বিষয়টি বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বরাবর জানানো হয়েছে। ডাক্তারদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবহেলার বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে সোনারগাঁ আসনের সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, সোনারগাঁয়ের কয়েক লাখ মানুষ একটি সরকারি হাসাপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। ডাক্তারদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে কোন রোগী কষ্ট করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, জনসংখ্যার দিক চিন্তা করে হাসপাতালটিকে সম্প্রতি ৫০ শয্যায় উন্নিত করা হয়েছে।