আজ শুক্রবার, ১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শ্রমিক মরছে মরবেই !

স্টাফ রিপোর্টার :

পহেলা মে বেশ ঘটা করেই পালন করা হয় শ্রমিক দিবস। ২শ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘অধিকার’ আদায়ের দিবস হিসেবে এই দিনটিতে সরব হন শ্রমিকরা। সেই ধারায় শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এই নারায়ণগঞ্জের রাজপথে মিটিং-মিছিলে আন্দোলনের ফোয়ারা তুলতে দেখা যায় শ্রমিক ও নেতাদের। এতো দীর্ঘ বছরের এই দিবস কেন্দ্রীক আন্দোলন বা কর্মসূচি কী পূর্ন অধিকার এনে দিয়েছে শ্রমিকদের?

এমন প্রশ্ন উঠলেও তথ্য বলছে, যাদের শ্রম ও ঘামে তিলে তিলে শিল্প-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ হয়েছে এই নারায়ণগঞ্জ, কর্মক্ষেত্রে সেই শ্রমিকদের ভাগ্যে এখনো মেলেনি নিরাপত্তার মৌলিক অধিকারটুকু। অট্টালিকা সাদৃশ্য কারখানাগুলোর অধিকাংশই নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পরিচালিত হচ্ছে বছরের পর বছর। এতে প্রায় সময়ই প্রাণ হারাচ্ছেন শ্রমিকরা। যেন কিছুই যায় আসে না কর্তাব্যক্তিদের। এ যেন শ্রমিক মরছে তো মরবেই!

সচেতন মহল বলছেন, শিল্প মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং কর্তাব্যক্তিদের উদাসীনতায় নারায়ণগঞ্জের কল কারখানাগুলোর অধিকাংশই যেন এক একটি জ¦লন্ত চিতা। যেখানে একেরপর এক অঙ্গার হচ্ছে শ্রমিক। পুড়ে মরছে শ্রমিকদের লালিত স্বপ্ন। রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জন শ্রমিক আগুনে ভস্মীভুত হয়ে সংশ্লিষ্টদের সেই স্বেচ্ছাচারিতা ও উদাসীনতাগুলোই যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন।

তথ্য বলছে, নারায়ণগঞ্জে গড়ে ওঠা অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত অগ্নি নিবার্পন ব্যবস্থা নেই। কারখানাগুলোর বিল্ডিং কোডেও রয়েছে অসঙ্গতি। ভবনগুলোতে নেই পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সিট। পর্যাপ্ত সেফটি ব্যবস্থা না থাকা সত্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রহস্যজনক ভাবে রয়েছে বিস্ফোরক ও ফায়ার সেফটির সনদপত্র! কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনসহ পরিবেশ অধিদপ্তরও ছাড়পত্র দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ! বছর বছর তা নবায়নও হচ্ছে! শুধু কী তাই? বিল্ডিং কোড না মেনে অধিকাংশ শিল্প কারখানা গড়ে উঠলেও অদৃশ্য কারণে সেদিকে নজর দিচ্ছে না রাজউক। অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা, ফায়ার এক্সিট বা ইমারজেন্সি এক্সিট ব্যবস্থা না থাকা এবং বিল্ডিং কোড না মেনেও যে নারায়ণগঞ্জে শিল্প কারখানা চালানো হয়েছে- রূপগঞ্জের হাসেম ফুডই এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

ফায়ার সার্ভিসের একটি সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে একই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন কারখানায় বয়লার বিস্ফোরন ও অন্যান্য কারণে ২৩ টি আগুনের ঘটনা ঘটেছিল। তথ্য বলছে এই সময়ের পরও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জসহ অন্যান্য থানা এলাকায় আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বয়লার বিস্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ড ও শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে। এরপরও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়নি। কর্তাব্যক্তিদের অনেকই আবার কেবল নোটিশ দিয়েই দায় সারছেন। কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নজির এখনো চোখে পড়েনি।

এই অবস্থায় বছর ঘুরে অরো একটি পহেলা মে এসেছে। বিগত দিনের ন্যায় আজও হয়তো সরব হবেন শ্রমিকরা। নেতারা হয়তো মঞ্চে মাইক হাতে গাইবেন শ্রমিকদের অধিকারের গান। এতে কী সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থার মৌলিক অধিকারটুকু মিলবে? শ্রমিকদের জন্য সেই আশা করাটাও খানিক বাড়বাড়ন্তই বটে!

জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘সমস্ত অধিকারের বিষয় নিয়েই আমরা আন্দোলন করে আসছি। তবে সত্যিকার অর্থে শ্রমিক সংগঠনগুলো এক হতে পারে না। নামে বেনামে শ্রমিক সংগঠন প্রায় পাঁচশত হবে। কিন্তু গার্মেন্টস ও নিটিং মালিকরা ঐক্যবদ্ধ। বিজেএমইএ ও বিকেএমইএ’র অধিনেই ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা ঐক্যবদ্ধ না হওয়ায় মালিকরা শোষন করে যাচ্ছে। অনেক শ্রমিক নেতারা আড়ালে ব্যবসায়ীদের সাথে আঁতাত করে। কিন্তু আমরা শ্রমিকদের অধিকারের জন্যই লড়াই করে থাকি।’

এরপরও কেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত হচ্ছে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে শ্রমিক লীগ নেতা হুমায়ুন বলেন, ‘কলকারখানা অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস আর পরিবেশ; এই ৩টি দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা অনেক সময় টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। তদন্ত না করেই টাকার বিনিময়ে ছাড়পত্র বা লাইসেন্স দিয়ে দেয়। তারা তাদের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করে না। বিশেষ করে কলকারখানা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা শ্রমিকের অধিকার না দেখে মালিকের অধিকার নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউক যদি তাদের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করে, তাহলে শ্রমিকরা তাদের নিরাপত্তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে।’