সংবাদচর্চা ডেস্ক:শীতলক্ষা নদী দূষণ মুক্ত রাখতে নারায়নগঞ্জে ৮০টি উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে এবং শীতলক্ষ্যা নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে মোবাইল কোটের পরিধি বাড়ছে বলে জানিয়েছেননৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ।
একই সভায় নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হয়াত আইভী শীতলক্ষ্যা নদী দখল ও দূষণমুক্ত করার তাগিদ দিয়ে একাধিক প্রস্তাব রাখেন। তিনি বলেন, শীতলক্ষ্যাকে বাচানোর বিকল্প নেই। দখল ও দূষণের কারণে এ নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া কলকারখানা গুলো ইচ্ছেমতো বর্জ্য নদীতে নিক্ষেপ করার কারনে দূষণ বাড়ছে।
সেলিনা হায়াৎ আইভী দাবী করেন, ঢাকার চারদিকে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর তীরে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানার বর্জ্য, গৃহস্থালি, ট্যানারি, হাসপাতাল ও ডাইং কারখানার বর্জ্য থেকে নদীকে দূষণমুক্ত করার জন্য সিঙ্গাপুরের মতো কঠোরভাবে জরিমানা চালু করেই নদীরক্ষা ও পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে হবে। নারায়ণগঞ্জের নদী ও পরিবেশ দূষণে পদক্ষেপ নিতে তিনি যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, সে সব আলোচনায় এনে জরিমানার পক্ষে মত দেন মেয়র।
নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ও উপস্থিত সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে মেয়র বলেন, সিঙ্গাপুর কঠোরভাবে জরিমানা জারি করতে করতেই আজ এমন উন্নত অবস্থায় পৌঁছেছে। নারায়ণগঞ্জে বালুর ট্রাকগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে। বালুগুলো যত্রতত্র ফেলা হয়। নদীগুলোতে আবর্জনা ফেলে ভরে ফেলা হচ্ছে। পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর প্রতিকার করতে হবে। জেল-জরিমানা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে শুধু নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানেই আমি মনে করি এমন সমস্যা হচ্ছে। তাই সবাইকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
জবাবে নৌমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের এসব বিষয়ে আরও সচেতন হতে বলেন। তিনি বলেন, আমিও মনে করি-কিছু জেল-জরিমানা চালু রাখা উচিৎ। বাধ্য না করলে অনেকেই নিয়ম মানতে চান না।
দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে শীতলক্ষা নদীর দখল ও দূষণ মুক্ত করতে মোবাইল কোর্টের পরিধি বাড়ানো কথা জানান মন্ত্রী। তিনি আরও জানিয়েছেন, এজন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআইডবিউটিএ এবং শিল্প ও নৌ মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করবে। বৈঠকে নৌ সচিব শফিক আলম মেহেদী, নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী, রাজউক চেয়ারম্যান, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
নৌমন্ত্রী বলেন, নদী দূষণমুক্ত করতে প্রকল্প গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের সমন্বিতভাবে কাজ করার ব্যপারে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, ঢাকার চারপাশের নদীগুলো যাতে আর নতুন করে দূষিত না হয় সেজন্য যারা বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করেও চালাচ্ছেন না তা চালু করার জন্য মনিটরিং টিম গঠন করা হবে। আর যারা ইটিপি স্থাপন করেনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।
নদী দখলমুক্ত করার প্রসঙ্গে নৌমন্ত্রী আরও বলেন, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতার আসার পর ঢাকার চারপাশের নদী দখল মুক্ত করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সেসময় ২০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে করা হয়। এখন টার্গেট আছে আরও ৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করার। ঢাকা ঘিরে মোট ১৪০ কিলোমিটার নদীপথ রয়েছে; এর সব জায়গায় ওয়াকওয়ে করতে হবে।
বৈঠকে বিআইডবিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর এম মোজাম্মেল হক জানান, ঢাকার চারপাশের নদী দূষণের ১৮৫টি উৎস নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১০৫টি আর নারায়ণগঞ্জে ৮০টি।
সূত্র জানায়, দিনের পর দিন নির্গত শিল্পবর্জে ব্যবহারের উপযোগীতা হারাচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি। ফলে বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তি নিয়ে সংকটে রয়েছে রাজধানীর মানুষ। সায়েদাবাদ পানি শোধনাগারের মাধ্যমে রাজধানীতে ওয়াসার সরবরাহ করা পানির ২০ শতাংশ আসে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে। কিন্তু শীতলক্ষ্যার পানি দূষণের মাত্রা মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সায়েদাবাদ পানিশোধনাগারে স্থাপিত প্রাক-শোধনযন্ত্র যথাযথ কাজে আসছে না। এতে পানিতে ক্ষতিকর উপাদান নাইট্রেট বেশি মাত্রায় থেকে যাচ্ছে। দূষণ কমাতে ঢাকা ওয়াসার পানিতে অতিরিক্ত মাত্রায় ক্লোরিন দেওয়া হচ্ছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
সম্প্রতি বুয়েটের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, শীতলক্ষ্যায় প্রতি লিটার পানিতে অ্যামোনিয়ার সহনীয় মাত্রা ৫ মিলিগ্রাম। ওই যন্ত্রটি বসানোর আগে সেখানে এমোনিয়ার মাত্রা ছিল প্রায় ১৪ মিলিগ্রাম। কিন্তু এখন তা প্রায় ২৫ মিলিগ্রাম। ফলে প্রাক-শোধনযন্ত্র খুব একটা কাজে লাগছে না। এমোনিয়ার মাত্রা বেড়ে যে পরিমাণ নাইট্রেট তৈরি করে তা মানবদেহ বিশেষ করে শিশুদের জন্য ক্ষতিকারক। অতিরিক্ত ক্লোরিনও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর।
২০০৫ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর তেজগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শীতলক্ষ্যায় যাওয়া বর্জ্য সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে ৩৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, আট ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে নদী দূষিত হচ্ছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট (ইটিপি) বসানোর আবশ্যকতা তুলে ধরা হয়। এর আলোকে ২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন করে উদ্যোগ নেয়। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে রাজধানীর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে ওই বছরের অক্টোবর মাসের মধ্যে ইটিপি বসানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয় নতুন করে উদ্যোগ নিলেও সব শিল্পকারখানা ইটিপি বসায়নি।