স্টাফ রিপোর্টার :
ষাট পেড়িয়ে বয়স গড়িয়েছে সত্তরের কোঠায়। ৬২ বছর বয়সে ৪র্থবারের মত এমপি হওয়া শামীম ওসমান প্রথমবার এই স্বাদ পেয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ৩৩ বছর বয়সেই এমপি হয়েছিলেন তিনি। সেই সময়ের শামীম ওসমানকে কেন্দ্র করে এই জেলার প্রতি বহিরাগতদের মাঝে ভিন্ন ধারনা জন্মেছে, এমন কথা প্রচলিত। একটি পক্ষ তাকে গডফাদার বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন প্রায় সময়। তবে সময় বদলেছে। বদলেছেন শামীম ওসমানও। ৩৩ বছর বয়সে তিনি অপরাধ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে বজ্র কণ্ঠে আওয়াজ না তুললেও সত্তরের কোঠায় দাঁড়িয়ে সেই আওয়াজ তুলেছেন।
তার বিরোধী মহলগুলো বলছেন, শেষ বয়সে এসে সুবোধ জেগেছে শামীম ওসমানের। সে যাই হোক, মাদক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে অরাজনৈতিক সংগঠন ‘প্রত্যাশা’র আত্মপ্রকাশ ঘটানোয় প্রসংশার দাবিদার আলোচিত এই এমপি। তবে প্রশ্ন উঠেছে তার চারপাশ নিয়ে। অপরাধ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেও তার চারপাশ জুড়ে বিতর্কিতদের ছাঁয়া কাটছেই না। এতে প্রশ্নের মুখে পড়েছে শামীম ওসমানের উদ্যোগ।
সচেতন মহল বলছেন, এই মহৎ উদ্যোগের বাস্তবায়ন করতে হলে আগে ঘর ঠিক করতে হবে তাকে। অর্থাৎ শামীম ওসমানের রাজনীতি করা কর্মীদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক, সন্ত্রাস, ভূমিদস্যু ও চাঁদাবাজির তিলক। এমন বিতর্কিত ব্যক্তিদের বেষ্টনিতে থাকা শামীম ওসমান কতটা সফল হবে, সেই প্রশ্ন এখন ভারি হচ্ছে। সুধিজনরা বলছেন, বিতর্কিত অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে শামীম ওসমানের ওই মহতী উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান।
গত শনিবার ‘প্রত্যাশা’ নামক অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে শামীম ওসমান সভার আয়োজন করেন। সেই মঞ্চ এবং দর্শক সাড়িতে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তিদের অবস্থান দেখা গেছে। যা নিয়ে সাধারন মানুষের মাঝে নেতিবাচক আলোচনা চলছে।
এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি, কলাগাছিয়া ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন, বন্দর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এহসান আহাম্মেদ, নাসিকের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু, সাবেক কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মন্ডল, সাবেক কাউন্সিলর সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল প্রধান, সাত খুন হত্যা মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের ভাই নূর উদ্দিন মিয়া ও ভাতিজা শাহজালাল বাদল, কাউন্সিলর সুলতান আহাম্মেদ, কাউন্সিলর রুহুল আমিন মোল্লা, গোগনগর ইউপি চেয়ারম্যান ফজর আলী, সাবেক কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মন্ডল, সিদ্ধিরগঞ্জের টেনশন গ্রুপ লিডার সীমান্তর বাবা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শফিক, বন্দরের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা খান মাসুদ, কুতুবপুরের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মীর হোসেন মীরু, চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী বিটু সহ এমন বিতর্কিত বেশ কয়েকজনকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাদের কেউ কেউ হত্যা, ভূমি দস্যুতা, মাদক বিক্রি ও চাঁদাবাজীসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে নিজেদের নাম জড়িয়েছেন। ঘুরে ফিরে তারা শামীম ওসমানের বলয়ের লোক। তাদের বিরুদ্ধে যদি এখনই ব্যবস্থা নেয়া না যায় তাহলে প্রত্যাশার লক্ষ্য কতটা পূরণ হবে- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, শামীম ওসমান বলয়ের পরিচিত মুখ কাউন্সিলর মতি। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় জেল খেটেছেন তিনি। মতি এবং স্ত্রী দুর্নীতির আশ্রয়ে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অঢেল সম্পদ অর্জন করেছেন বলে দুদকের তদন্তে বেড়িয়ে এসেছে। মতির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজী ও প্রতারণা করে জমি দখলেরও চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে দুদকের তদন্তে। পাশাপাশি মতির বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমি দখল, দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৩টি মামলা হয়েছে। নানা অপরাধের কারণে মতি এখন তার নির্বাচনি এলাকাতেও প্রশ্নবিদ্ধ।
শামীম ওসমানের বলয়ের কর্মী সাবেক কাউন্সিলর সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল প্রধানের বিরুদ্ধে ভূমি দস্যুতার অভিযোগ রয়েছে। তিনি ইতিপূর্বে ফেনসিডিল সহ গ্রেফতারও হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
বন্দরের ছাত্রলীগ নেতা খান মাসুদের বিরুদ্ধেও রয়েছে চাঁদাবাজী এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ। বিশেষ করে, বন্দরের অবৈধ স্ট্যান্ড এবং তা থেকে চাঁদাবাজী সহ কিশোরগ্যাং বাহিনী পরিচালনার অভিযোগ এই খান মাসুদের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে, কুতুবপুরের মীর হোসেন মীরু পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং তার বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, মাদক এবং চাঁদাবাজী সহ ভূমিদস্যুতার দায়ে ২০টির মত মামলা রয়েছে। কুতুবপুরে মীরু এখন এক আতঙ্কের নামও বটে!
নাসিক ৩নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শাহজালাল বাদল সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের আপন ভাতিজা। তাঁর বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির ৮টি মামলা এবং যশোরের কোতোয়ালি থানায় ১টি প্রতারণার মামলা রয়েছে।
নূর হোসেনের ভাই নূরউদ্দিন মিয়া ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের আটটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটিতে খালাস পেয়েছেন।
আর কাউন্সিলর সুলতানের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক ও চাঁদাবাজিসহ চারটি মামলা বিচারাধীন আছে।
নাসিক ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রুহুল আমিন মোল্লার আপন বড় ভাই খোকন মোল্লা একজন মাদক বিক্রেতা। গত পরশু তাকে ২০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট সহ গ্রেফতার করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ। এতে কাউন্সিলর রুহুল আমিন মোল্লাকে নিয়েও আলোচনা সমালোচনা চলছে।
এদিকে, সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজী এবং ভূমিদস্যুতার অভিযোগ বহু পুরনো।
নাসিকের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল করিম বাবুর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ দু’টি মামলা বিচারাধীন। এর আগে সাতটি মামলা ছিল তাঁর বিরুদ্ধে, যেসব মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
সিদ্ধিরগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শফিকুল ইসলামের ছেলে রাইসুল ইসলাম সীমান্তকে কিশোরগ্যাং ‘টেনশন গ্রুপ’ পরিচালনার অপরাধে গ্রেফতার করেছিল র্যাব-১১। শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধেও সিদ্ধিরগঞ্জে ডিলারসহ টিসিবির পণ্যসামগ্রীর গাড়ি ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির আটটি মামলা থাকলেও সবকটি থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন।
এদিকে, ‘রাজাকারপুত্র’ মুছাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেন, তার স্ত্রী নার্গিস বেগমের বিরুদ্ধে অন্যের সম্পত্তি জাল দলিল করে দখলের অভিযোগে ২০১৫ সালে মামলা হয়। এছাড়া তার ছেলে মাহমুদুল হাসান শুভর বিরুদ্ধে পুলিশের উপর হামলা, জমি নিয়ে হামলা, টাকা লুটের মতো অভিযোগ আছে।
বন্দরের আরেক রাজাকারপুত্র এহসান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও পরিষদের অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির দায়ে সম্প্রতি মামলা দায়ের করেছে দুদক।
গোগনগরের চেয়ারম্যান ফজর আলীর বিরুদ্ধে তাঁর এলাকায় কিশোর গ্যাং গ্রুপ ‘বিচ্ছু বাহিনী’ পরিচালনা ও ভূমিদস্যুতার অভিযোগ রয়েছে। সাবেক ইউপি মেম্বার দৌলত হোসেন হত্যার ঘটনাতেও ফজর আলীর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ‘বিচ্ছু বাহিনী’ জড়িত ছিল বলে অভিযোগ প্রতিপক্ষের লোকদের।
অন্যদিকে, কলাগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির দায়ে দুদকে মামলা হয়েছিল।
তথ্য মতে, এসকল কর্মীদের বাহিরেও ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জে শামীম ওসমানের একাধিক কর্মী সমর্থক রয়েছে যাদের অনেকেই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও মাদক সহ বিভিন্ন সেক্টর নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ এলাকাতেই প্রশ্নবিদ্ধ। কেউ প্রকাশ্যেই অপরাধে সম্পৃক্ত আবার কারও আপন ভাই-ভাগিনা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বিভিন্ন সেক্টর। যদিও তারা প্রত্যেকেই শামীম ওসমানের বলয়ের অনুসারী। এতে প্রশ্ন উঠেছে, এমন বিতর্কিত কর্মীদের ভিরে আদৌ কী প্রত্যাশা পুরণ হবে শামীম ওসমানের? নাকি শেষ বয়সের এই উদ্যোগ ভেস্তে যাবে বিতর্বিক অনুসারীদের স্রোতে, সেই প্রশ্নই এখন ভারি হচ্ছে।