আজ সোমবার, ২৬শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শক্ত কাঠে করুণ কান্না

সাবিত আল হাসান
কাঠের কামে ভালো মানুষ আহে না। যেসব পোলাপান এলাকায় শয়তানি কইরা বেড়ায়, মা বাবার কথা শুনেনা, তাগোরে বাপ মায় এই কামে পাডায়। খালি আমিই উলটা শখ কইরা আইছি। ছোটবেলায় মিলের লগে লাকড়ি জোগাড় করতে করতে এই কাজ শিখছি। এখন যে এই কষ্টের কাম ছাইড়া দিমু হেই উপায়ও নাই। আমার জীবনডা ভইরা খালি খাটনিই গেল। কথাগুলো বলছিলেন স’ মিলের শ্রমিক আজহার মিয়া।
শেষ কবে এমন বেকার জীবন কাটিয়েছেন তার মনে নেই। করোনার প্রাদুর্ভাবে প্রায় ৪ মাস ধরে বেকার সময় কাটাচ্ছেন আজহার মিয়া (৪৭)। মাঝে মাঝে মিলের টুকটাক কাজ করলেও সেসব দৈনন্দিন কাজের তুলনায় কিছুই না। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অলস সময় আর সহকর্মীদের সাথে আড্ডাতেই কেটে যায় দিন। তবে মাথা জুড়ে চেপে আছে ৬ সদস্যের পরিবারে আহার জোগানোর চিন্তা। অর্থনৈতিক সংকটে ভিন্ন কিছু যে করবেন সেই সাহসটাও যেন হারিয়ে ফেলেছেন। দীর্ঘদিনের পেশার এমন পরিস্থিতি দেখে নিজেকে খুবই ছোট ভাবতে শুরু করেছেন তিনি। তাই নিজের ছবিটিও পেশার সাথে জড়িয়ে রাখতে চাননা।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আজহার মিয়া। কাজ করছেন ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড সংলগ্ন দরবার টিম্বার এড স’ মিলে। ২ মেয়ে ২ ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। মেজ মেয়ে নিচ্ছেন বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি। বাকি দুই ছেলে স্বাভাবিক ভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন পড়াশোনা। নিজের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির প্রভাব পরিবারের উপর পড়তে দেননি কখনই। আশা, মেয়ে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তির্ণ হলে হয়তো ঘুরবে ভাগ্যের চাকা।
আজহার মিয়া ছোটবেলা থেকেই বেড়ে উঠেছেন কুতুবপুরে। নিজ বাড়ির রান্নার কাজের জন্য লাকড়ি সংগ্রহ থেকে শুরু হয় স’ মিলের সাথে পরিচয়। শিখেন কাঠ টানা ও কাটার কাজ। ১৯৮১ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে মিলের ছোটখাটো কাজ করে দেয়া শুরু করেন। ধীরে ধীরে কৈশোর যৌবন সবই ব্যয় করেছেন স’ মিলে। মাঝে কিছুদিন চট্টগ্রামে গিয়ে কাজ করলেও বছর খানেক পরে আবারও ফিরে এসেছেন পুরনো নিবাসে।
প্রতিবেদকের সাথে চায়ের আড্ডার এক পর্যায়ে নজরে এলো তার ডান হাতের বৃদ্ধ ও তর্জনির আঙ্গুল নেই। বোধগম্য হলো কড়াতেই কেটেছে তার এদুটি আঙ্গুল। নতুন করে জিজ্ঞেস না করে জানতে চাওয়া হলো কবে ঘটলো এ দুর্ঘটনা?
মুখে বেদনার হাসি ফুটিয়ে তুলে বলেন, ৯০ সালের দিকে কাইটা গেসিলো আঙ্গুল দুইটা। এই লাইনে আঙ্গুল কাটা স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক সময় তো করাত ছুইট্টা গিয়া শইল্লেও লাগে। তখন অবস্থা মারাত্বক হইয়া যায়। ২০০০ সালের আগে একটা মোটা গরুর চামরা বুকে পেটে বাইন্দা কাম করতো সবাই। কিন্তু এখন আর ঐসব নাই। কপাল খারাপ থাকলে কাটবোই। এইসব মাইনাই সবাই কাম করতে আহে।
শুধু তাই নয়, পুরো কর্মক্ষেত্রে নেই কোন আর্থিক বা জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা। কোন কারনে শ্রমিক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হলে মালিকের মর্জির উপর নির্ভর করে ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা। মালিক কোন কারনে বাড়তি খরচ বহন করতে না চাইলে ভুক্তভোগী শ্রমিকের কিছুই করার থাকে না। এছাড়া শ্রমিকদের বয়স হয়ে এলে দীর্ঘদিনের কর্মচারীকে দেয়া হয়না বাড়তি অর্থ বা সন্মানী। অথচ বছরের পর বছর মালিককে সমৃদ্ধ করে তোলেন তারাই। একই সাথে দেশের কাঠ শিল্পে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন আজহার মিয়ার মত অসংখ্য অবহেলিত শ্রমিকরা। তাদের হাত ধরেই প্রতিদিন কাঠের আসবাবপত্রে সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রতিটি মানুষের ঘরবাড়ি।
করোনার এমন অবস্থা দীর্ঘদিন থাকলে কি করবেন এমন প্রশ্নে বলেন, কিছুই করার নাই। আল্লাহ চালাইতাছে তাই চলতাছি। কুতুবপুরের সেন্টু চেয়ারম্যান ২০ কেজি চাল দিসিলো ওইপর্যন্তই। এরপর তো সব আমারই করন লাগছে। মেম্বারেও কিছুই দেয়নাই। সরকার যদি আমাগো দিকে একটু তাকাইতো তাইলে অনেক উপকার হইতো। একদিকে নাই আমাগো কামের নিরাপত্তা, আর এখন ইনকামের নিরাপত্তাও যাইতাছে। আমাগো দিকে একটু ফিরা তাকাইলে এই লাইনের মানুষগুলা একটু শান্তিতে থাকতে পারতো।