আজ শনিবার, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

“ব্যাথামুক্ত স্বাভাবিক প্রসবেই হতে পারে ফুটফুটে শিশুর জন্ম”

#আসলেই কি ব্যাথামুক্ত নরমাল ডেলিভারি সম্ভব.??
হ্যা, সম্ভব।বেশ ভালোভাবেই সম্ভব।মর্ডান এনেস্থেটিক প্র‍্যাক্টিসে ব্যাথামুক্ত করার স্বীকৃত বেশ কিছু পদ্ধতির মধ্যে চমকপ্রদ পদ্ধতি ‘এপিডুরাল এনালজেসিয়া’।এর মাধ্যমে রোগীকে (৭০-৯০) ভাগ ব্যাথামুক্ত রেখে নরমাল ডেলিভারি সম্ভব।

একটা ঘটনা বলি।
আমার এক ডাক্তার বন্ধু।নরসিংদী জেলা শহরে তার বাস।ওখানকার এক হস্পিটালেই কাজ করে।বন্ধু এবং বন্ধুর বউ, দুই জনেরই ইচ্ছা নরমাল ডেলিভারিতেই যেন তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়।বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো সব কিছুই ঠিকঠাক আগাচ্ছিলো।একদিন ভোরবেলায় ওর ওয়াইফের লেবার পেইন উঠলো।হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো।সময়ের সাথে ব্যাথা বাড়ছে, পেটের বাচ্চা ও জন্ম নেয়ার পথে আগাচ্ছে।সবকিছুই প্রায় ঠিকঠাক।কয়েক ঘন্টা পরে যখন স্বাভাবিকভাবেই ব্যাথা বেড়ে যায় আর পেশেন্ট চিৎকার করতে থাকে, তখনই পেশেন্টের মা-বোন প্লটে আসে।তারা কোনভাবেই তাদের মেয়েকে ব্যাথা পেতে দিবে না!সিজারিয়ান সেকশন করে ফেলবে!আমার বন্ধু এবং গাইনোকলোজিস্ট যতই বন্ধুর শ্বাশুড়িকে বুঝাক না কেন, নরমাল ডেলিভারিতেই বাচ্চা হয়ে যাবে।তারা কোনভাবেই তাদের মেয়েকে ব্যাথা সহ্য করতে দিবে না।শেষে সিজার করে বাচ্চা বের করা হলো!সিজারের পর ফ্রেন্ড বলে দোস্ত, বাচ্চা এতোটাই নিচে নেমে গিয়েছিলো যে পেট কাটার পরেও মাসিকের পথ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে পেট দিয়ে বাচ্চা বের করা লাগছে.!
প্রসবজনিত এই ব্যাথা সহ্য করতে না পারার জন্যই ডাক্তারদের অনিচ্ছা স্বত্তেও আপাত প্রয়োজনহীন এতো বড় অপারেশন.!
এই রোগীকে যদি ব্যাথামুক্ত করে দেয়া যেতো, সে নিশ্চিতভাবেই নরমাল ডেলিভারির দিকে আগাতো এবং তার বাচ্চাটা পেটে কোনরকম কাটাছেড়া ছাড়াই জন্ম নিতো।দূরভাগ্যজনকভাবে ওই সময় সেই হস্পিটালে ব্যাথামুক্ত নরমাল ডেলিভারির ব্যবস্থা ছিলো না।
প্রচন্ড ব্যাথার এই সময়টাতে এপিডুরাল এনালজেসিয়া হতে পারে ম্যাজিক্যাল সমাধান।

প্রথমবার প্রেগন্যান্ট হওয়া যে কোন মেয়েকে যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন যে তিনি তার আসন্ন ডেলিভারির ব্যাথা নিয়ে উদ্বিগ্ন কিনা।বেশিরভাগ মায়েরই উত্তর হবে, আমি মনেহয় ব্যাথা সহ্য করতে পারবো না! ব্যাথায় আমি বোধহয় মারাই যাবো!

>> লেবার পেইন কেন হয়.?
=বাচ্চা জন্ম নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়া থেকে প্লাসেন্টা(ফুল) ডেলিভারি হওয়া পর্যন্ত সময়টাকে ৩টা স্টেজে ভাগ করা হয়।এর মধ্যে ১ম ও ২য় স্টেজে রোগী ব্যাথা অনুভব করে যেটা ধীরে ধীরে বেড়ে চূড়ান্ত রূপ নেয়।প্রথম দিকে ব্যাথা মূলত বাচ্চা জন্ম নেয়ার পথ প্রস্তুত করতে জরায়ুর নিচের অংশ(সারভিক্স) প্রসারিত হয় এবং উপরের অংশে আইসোমেট্রিক কন্ট্রাকশন হয়।মানে উপরের অংশ চাপ দেয় আর নিচের অংশ প্রসারিত হয়ে মাসিকের রাস্তাকে বড় করে দেয়। এই চাপ এবং প্রসারনের ফলে রক্ত চলাচল প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়ে ব্যাথার রিসিপ্টরকে(Nociceptors) উত্তেজিত করে এবং এই অনুভূতিকে(Through C & A-delta fibers) মেরূদন্ড(Spinal cord) হয়ে ব্রেইনে নিয়ে যায়।রোগী ব্যাথা অনুভব করে।২য় স্টেজে গিয়ে চাপ এবং প্রসারনের পাশাপাশি রোগীর তলপেট(পেলভিস) আর মাসিকের রাস্তার চারপাশের(পেরিনিয়াম) টিস্যু ড্যামেজ হয় বলেও রোগী প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করে।

#বাচ্চা জন্ম দেয়ার সময় একজন মা ঠিক কতটা ব্যাথা অনুভব করে.?
এই ব্যাপারে অনেক মিথ প্রচলিত। ২০টা হাড় ভাংগার সমান ব্যাথা! ৫৭ ডেসিবেল কিংবা ৪৫ ডেসিবেল ব্যাথার কথা প্রচলিত আছে।তবে ব্যাথা অনুভবের ব্যাপারটা পুরোপুরিই ব্যাক্তি কেন্দ্রিক। একেকজনের পেইন থ্রেসহোল্ড বা ব্যাথা সহ্য করার ক্ষমতা কিংবা ব্যাথার অনুভূতি একেক রকম।এটাকে সরলভাবে আসলে সংগায়িত করা যায় না।তবে এটা ঠিক যে, বেশিরভাগ মায়েরই জীবনের কঠিনতম ব্যাথা এই প্রসব বেদনা।

এই ব্যাথা কমানোর উপায় কি.?
সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে ‘এপিডুরাল এনালজেসিয়া’। যেটা একজন এনেস্থেশিওলজিস্ট নিশ্চিত করে থাকেন।
এই পদ্ধতিতে মায়ের পিঠে মেরুদন্ডের নিচের অংশে স্পাইনাল ক্যানাল এর বাইরে এপিডুরাল স্পেসে, যেখান দিয়ে মূলত নার্ভ গুলা বের হয় সেখানে একটি নল বা ক্যাথেটার প্রতিস্থাপন করে নির্দিষ্ট মাত্রায় কয়েক ধরনের ওষুধ দেয়া হয়।এর মাধ্যমে মা প্রসবের সবগুলা স্টেজেই প্রায় ব্যাথামুক্ত থাকে।

এই ওষুধ কখন দেয়া শুরু করতে হয়.?
সত্যিকারের প্রসব বেদনা নিশ্চিত হওয়ার পর মায়ের অনুরোধই যথেষ্ট এই প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য।তবে সাধারণত (৪-৫) সেন্টিমিটার সারভাইকাল ডাইলেটেশন বা (৩-৪) আংগুল পরিমান জরায়ু মুখ খুললে এই ওষুধ দেয়া শুরু করা হয়।ওষুধ দেয়ার ১৫-২০ মিনিট পর ব্যাথা অনুভব বন্ধ হয়।মা কেবল জরায়ুর সংকোচন জনিত চাপ কিছুটা অনুভব করতে পারে।

এপিডুরাল এনালজেসিয়ার সুবিধা.?
এটার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটা শুধুমাত্র ব্যাথার কারনে সিজারের পরিমান কমিয়ে নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে বহুলাংশে।
-এই প্রক্রিয়ায় মায়ের স্বাভাবিক প্রসবের কোন ব্যাঘাত ঘটে না। মা, বাচ্চাকে পুশ করতে পারে, হাটাচলা করতে পারে, বাথরুমে যেতে পারে, ব্যাথা না থাকার ফলে এংজাইটি হয় না,শ্বাস-প্রস্বাস ব্লাড প্রেশার ও হরমোন জনিত পরিবর্তন গুলা হয় না।এটা মা এবং বাচ্চা দুই জনের জন্যই উপকারি।
-যদি কোন কারনে সিজার এর প্রয়োজন হয় তাহলে নতুন কোন পদ্ধতিতে এনেসথেশিয়া দেয়া লাগে না।
-গবেষনায় দেখা গিয়েছে ব্যাথামুক্ত নরমাল ডেলিভারি পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন ও সিগনিফিকেন্টলি কমায়।

অসুবিধা.?
এই প্রক্রিয়া কিছুটা ব্যায়বহুল। এনেস্থেশিওলজিস্ট এবং গাইনোকলোজিস্ট এর সার্বক্ষনিক উপস্থিতি আর এপিডুরাল সেট সহ মা ও বাচ্চার(সিটিজি) মনিটরিং এর জন্য বেশ কিছু যন্ত্র প্রয়োজন হয়।
এই বাইরে সঠিক ডোজে সাধারণত মায়ের তেমন কোন অসুবিধা হয় না।কিছু ক্ষেত্রে সামান্য প্রেশার কমে যাওয়া, বমি ভাব হওয়ার মতো ছোট খাটো কিছু প্রব্লেম হতে পারে যেটা একজন এনেস্থেশিওলজিস্ট সহজেই ম্যানেজ করতে পারেন। হাটার সময় একজন সহকারী প্রয়োজন হতে পারে আর বাচ্চা পুশ করার প্রক্রিয়া কিছুটা ধীর হতে পারে।এপিডুরাল এর বেলায় নার্ভ ড্যামেজ খুবই,আমি আবারও বলছি খুবই রেয়ার এবং এর জন্য পরবর্তীতে কোন কোমড় ব্যাথা হয় না।

লেখক
ডা. তানজিল হাসান
এমবিবিএস, ডিএ
এফসিপিএস(ফাইনাল পার্ট)
এনেস্থেসিয়া,পেইন,পেলিয়েটিভ এন্ড ইনটেনসিভ কেয়ার।
কনসালট্যান্ট ; ইউ এস বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ