আজ বৃহস্পতিবার, ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

‘পুলিশ বলে আমরা নাকি মারছি’

# বস্তাবন্দি স্কুলছাত্রীর লাশ
# নিহতের মা-বাবাকে থানায় ধরে নিয়ে নির্যাতন, হত্যার দায় স্বীকারে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ
# তারা প্লাস দিয়ে আমার আঙ্গুলে চাপ দিয়েছে। দুদিন আঙ্গুল ফুলে ছিল, ভয় দেখিয়ে মামলা করিয়েছে, সেখানে কি লেখা ছিল জানি না
# -নিহত স্কুলছাত্রীর মা  

স্টাফ রিপোর্টার :
সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী পশ্চিম পাড়ার রাস্তা থেকে দুই গলির মাথায় দেলোয়ার হোসেন খোকার বাড়ি। টিনশেডের কাঠের পাটাতন করা দ্বিতল বাড়ি। লোহার সিঁড়ি দিয়ে উপরের তলায় উঠতেই দেখা মিলে কপালে হাত দিয়ে মেঝেতে বসে থাকা এক নারীর। পাশেই বিছানায় বসে টিভি দেখছে এক শিশু। ঘরে আসবাবপত্র বলতে রয়েছে দুটি চেয়ার। জানতে চাইলে ওই নারী জানান, তিনি শাহিন আক্তার নেহা। গত ২ মে উদ্ধারকৃত স্কুলছাত্রীর লাশটি তার মেয়ে স্বপ্না আক্তারের। এর আগে গত ৩০ এপ্রিল নিখোঁজ হয়েছিল অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এই স্কুলছাত্রী।
শাহিনা আক্তার নেহা জানান, তার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে নিহত স্বপ্না আক্তার এমডব্লিউ স্কুলের ৮ম শ্রেণীর স্কুল ছাত্রী ছিল আর ছোট মেয়ে ৬ বছরের অনামিকা আক্তার আরেকটি বেসরকারি স্কুলের ছাত্রী। শাহিনা আদমজী ইপিজেডের এপিক ওয়ান গার্মেন্টেসে সিনিয়র অপারেটর। গত ১৬ বছর যাবৎ তিনি সেখানে কর্মরত আছেন। তার স্বামী দেলোয়ার হোসেন এক সময় ফার্সেমীর দোকান পরিচালনা করতেন কিন্তু অসুস্থতার কারণে বিগত কয়েক বছর ধরে সে বাসায় থাকে দুই মেয়ের দেখাশোনা করেন।
নিখোঁজের হবার দিনের (৩০ এপ্রিল) ঘটনা বর্ণনা করে নেহা বলেন, স্বপার স্কুল শুরু হয় ৭টায়। আমার মেয়ে বের হয় সাড়ে ৬টায় আর আমি বের হই পৌনে ৮টায়। যাবার আগে স্বপ্না আমার কাছে ২০ টাকা চায় বান্ধবীদের সঙ্গে তেঁতুল খাওয়ার জন্য। আমার কাছে না পেয়ে তার বাবাকে ঘুম থেকে তুলে টাকা চাইলে ওর বাবা বালিশের নিচ থেকে টাকা বের করে দেয়। এরপর যথারীতি স্বপ্না স্কুলে চলে যায়। রাতে বাড়ি ফিরলে ছোট মেয়ে অনামিকা বলে, আপি বাড়ি ফিরেনি। আমি ও আমার হাসব্যান্ড অনেক খোঁজাখুজি করেছে কিন্তু পাইনি।
থানায় নিখোঁজ জিডি করেছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মেয়ে এর আগেও একবার রাগ করে বান্ধবীর বাড়িতে গিয়েছিল। তাই আমি ভেবেছি এমন কিছু হয়েছে। পরদিন সকালে একই এলাকার মেয়ে সানিয়া আক্তারের (স্বপ্নার বান্ধবী) সাথে কথা বলি। সানিয়া বলে, ১২ ঘণ্টা আগে রাত ৩টার সময় স্বপ্না নাকি অনলাইন ছিল এবং তাদের কথা হয়েছে। সানিয়া আমাকে বলে, আন্টি চিন্তা কইরেন না। তাই আমি অপেক্ষা করছিলাম। হয়তো সে বাড়ি ফিরবে। এছাড়া ওর একাধিক ছেলে বন্ধু ছিল। প্রায়ই আমার ফোন দিয়ে কথা বলতে দেখতাম। আর উঠতি বয়সের মেয়ে, থানা-পুলিশ করলে বিয়ে দিতে পারবো না। এসব ভেবে আর জিডি করিনি।
বৃহস্পতিবার স্বপ্নার লাশ উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লাশ উদ্ধারের সময় আমরা লাশ দেখতে গিয়েছিলাম কিন্তু চিনতে পারিনি। লাশ ফুলে মোটা হয়েছিল আর আমার মেয়ে চিকন। এছাড়া চেহারার নষ্ট হয়েছিল আমিই চিনতে পারিনি। পরে থানায় গিয়ে পরনের জামা ও টাইস থেকে লাশ শনাক্ত করি।
সেদিন রাত ৮টায় পুলিশ নেহা ও তার স্বামী দেলোয়ারকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় বলে জানায় নেহা। পুলিশ তাদের হত্যার অভিযোগ স্বীকার করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, পুলিশ বারবার বলে, আমরা মেরেছি। আমাদের আলাদা রেখে জিঞ্জাসাবাদ করে। আমারে বলে, তুমি বলো তোমার হাসব্যান্ড মেরেছে। তুমি লিখিত দাও যে, শাসন করতে গিয়ে মারা গেছে। কিন্তু এমন কিছু তো হয়নি। বাবা-মা একটু-আধটু শাসন তো করবেই কিন্তু কেউ কি নিজের সন্তানকে শাসন করতে করতে মেওে ফেলবে! ২০০৮ সালে আমি চাকরীতে জয়েন করি আর ২০১০ সালে স্বপ্নার জন্ম হয়। এরপর থেকে বাপেই দেখাশোনা, চুল বেঁধে দেয়া থেকে শুরু করে সবকিছু করেছে। সে কিভাবে স্বপ্নাকে মারবে? দেলোয়ারের পিত্তথলীতে পাথর ধরা পরার কারণে তার পিত্তথলী ফেলে দেয়া হয়েছে। তার হৃদপিন্ড দুর্বল এবং তার ডায়াবেটিকসও আছে।
থানায় তাদের মারধর করার অভিযোগ করে নেহা তার হাতের আঙ্গুল দেখিয়ে বলেন, তারা প্লাস দিয়ে আমার আঙ্গুলে চাপ দিয়েছে। দুদিন আঙ্গুল ফুলে ছিল, নাড়াচাড়া করতে পারিনি। আমাকে অনেক ভয় দেখিয়ে, শনিবার আমারে বাদি করে একটি মামলা করিয়েছে। মামলায় কি ছিল আমি কিছু জানি না। মামলা করার পর বেলা ৩টার দিকে আমাদের দুজনকে ছেড়ে দেয়। বাড়িতে ফিরে আমরা স্বপ্নার দাফন সম্পন্ন করি। পরে রাত ৮টায় আবার আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। সে এখনও থানায়।
সে ভীত অবস্থায় আছে জানিয়ে নেহা বলেন, দারোগা শওকত বলসে আমার থানায় যাওয়ার দরকার নাই। ভয়ে আমি থানায় যাই না। এলাকার একজনকে থানায় পাঠিয়েছিলাম, সে জানিয়েছে কাল (শনিবার) আমার হাসব্যান্ডকে চোখ বেঁেধ অনেক মারছে। ছোট মেয়েটার জন্য ভয় লাগে। আমাকেও যদি ধরে নিয়ে যায় তাহলে ওকে দেখবে কে? এ কারণে আমি ঘর থেকেও বের হই না।
পুলিশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পাইছে সাড়ে ৯টায় স্বপ্না বাড়ির দিকের প্রথম গলিতে ঢুকেছে। কিন্তু সে ঘরে আসছে নাকি অন্য কোথাও গেছে আমি কিছুই জানি না। স্বপ্না যখন গলিতে ঢুকে তখন তার পরনে স্কুল ড্রেস, জুতা আর কাঁধে ব্যাগ ছিল। কিন্তু লাশ উদ্ধারের সময় স্বপ্নার পরনে ড্রেস থাকলেও জুতা ও স্কুলব্যাগ পাওয়া যায়নি।
বাড়ির একাধিক ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিখোঁজের দিন কেউ স্বপ্নাকে দেখেনি। এমনকী বাড়ির মধ্যে কোনো রকম শব্দও পায়নি।
তার পরিবারের সঙ্গে কারো বিরোধ আছে কিনা জানতে চাইলে নেহা জানান, সাবেক কাউন্সিলর আলার পরিবারের সাথে জমি সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে। কিছুটা দূরের একটি নারিকেল গাছ দেখিয়ে নেহা বলেন, প্রথমে আমরা ওই গাছের নিচে আমার শ^শুরের তৈরি বাড়িতে থাকতাম। গতবছর কাউন্সিলরের ছেলে আলামিন আমাদের বাড়ি ভেঙ্গে দেয়। শুনেছি, কাউন্সিলর নাকি আমার চাচা শ^শুড় থেকে জমি কিনেছে। এ নিয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে মামলা চলছে। একাধিকবার মিমাংসার জন্য ডেকেছিল কিন্তু আমার স্বামী জাননি। এর বেশি আমি আর জানি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহত স্বপ্নার এক নিকটআত্মীয় জানান, স্বপ্নার বাবা দেলোয়ার হোসেন খোকার আগের একটি সংসার আছে। সেই ঘরেও ছেলেমেয়ে রয়েছে। নিহত স্বপ্না হচ্ছে দ্বিতীয় সংসারের বড় মেয়ে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সিদ্দিক বলেন, নিহতের মা বাদি হয়ে একটি মামলা করেছেন। তবে করো নাম উল্লেখ করা হয়নি, আসামী অজ্ঞাতনাম। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দেলোয়ার হোসেনকে থানায় আনা হয়েছে। সম্পত্তির জেরে হত্যাকাণ্ড হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মামলার তদন্ত চলছে এর বেশি কিছু বলা যাবে না।
উল্লেখ্য, গত ৩০ এপ্রিল সকালে স্কুলে যাওয়ার পর নিখোঁজ হয় স্বপ্না আক্তার। সে সিদ্ধিরগঞ্জ এমডব্লিউ স্কুলের ৮ম শ্রেণীর স্কুল ছাত্রী। নিখোঁজের তিনদিন পর ২ মে নিজ বাড়ির কিছুটা দূরে চাচার পরিত্যাক্ত বাড়ির পাশে ময়লার স্তুপে বস্তাবন্দি স্বপ্নার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ জানায়, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে নিখোঁজের পরদিন তাকে হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে ওই ময়লার স্তুপের ভেতর রেখে দেওয়া হয়েছে। লাশটি কাঁথা দিয়ে মোড়ানো ছিল। গলার ৩ জায়গায় কাটা রয়েছে। লাশে পঁচন ধরে গেছে। চেহারা দেখে চিনার উপায় নেই।