স্টাফ রিপোর্টার :
নিখোঁজের ২ মাস পর জানা গেল নারায়ণগঞ্জের এক কিশোরী ভারতের সেফ হোমে রয়েছে। প্রেমের টানে যুবকের সাথে পালানোর পর কথিত শাশুড়ী তাকে বিক্রি করে দেয় সেখানকার পতিতালয়ে। তবে কিশোরী তা বুঝতে পেরে আশ্রয় নেয় পুলিশের কাছে। দূতাবাসের কর্মকতাদের মাধ্যমে সেই খবর পেয়ে তাকে ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের দাড়ে দাড়ে ছুটছে সপ্তম শ্রেনীর ওই শিক্ষার্থীর অসহায় পরিবার।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ শহরের গলাচিপার ডিএন রোড এলাকার সপ্তম শ্রেনিতে পড়ুয়া এক কিশোরীর প্রেমের সর্ম্পক গড়ে উঠে প্রতিবেশী যুবক নাঈমের সাথে। গত দুই মাস আগে মার্কেটে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয় কিশোরী রাবেয়া আক্তার মুক্তা। তারপর থেকে ছিলো নিখোঁজ। হঠাৎ করে ভারতীয় দুতাবাসের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে খোঁজ মিলে তার। জানানো হয়, ওই কিশোরী ভারতের একটি হোম সেলে রয়েছে। নিখোঁজ কিশোরীর পরিবারকে জানানো হয় ভারতীয় পুলিশ তাকে সেখানে রেখেছে। এতেই বেড়িয়ে আসে ঘটনার নেপথ্যের গল্প।
কিশোরীর পরিবার জানায়, তার মেয়ের ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সাথে মুঠো ফোনে কথা বলে তারা জানতে পারেন প্রতিবেশী নাঈম তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে নাঈমের মা ফারজানা ঘরে মুন্সি ডেকে কথিত বিয়ে পড়ান। এর কিছুদিন পর ওই কিশোরীকে চিকিৎসার কথা বলে তার কথিত শ্বাশুড়ী ফারজানা তাকে বাংলাদেশ থেকে জয়পুর সীমান্ত পেড়িয়ে নিয়ে যায় ভারতে। কিশোরীকে বানিয়ে দেন আদার কার্ড। কথিত শ্বাশুড়ী ফারজানা নিজের নাম পরিবর্তন করে আদার কার্ডে নতুন নাম লিখেন অনামিকা রাহুল দে। অন্যদিকে, ওই কিশোরীর আদার কার্ডে তার নতুন নাম দেয়া হয় পুজা রাহুল দে। এরপর সেখানে একটি পতিতালয়ে ওই কিশোরীকে বিক্রির চেষ্টা করে তার কথিত শ্বাশুড়ী। কিশোরীটি তা বুঝতে পেরে সেখান থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয় ভারতীয় পুলিশের কাছে। ধরিয়ে দেয় কথিত শ^াশুড়ী ফারজানাকে। বাংলাদেশী কিশোরকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করায় কথিত ফারজানা এখন সেখানকার কারাগারে।
বর্তমানে পুলিশ ওই কিশোরীকে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির (সিডব্লিউসির) নির্দেশে চিকিৎসা করিয়ে হোম সেলে পাঠায়। এদিকে মেয়ের সন্ধান পাওয়ার পর থেকে তাকে ফিরে পেতে বেকুল হয়ে উঠেছে পরিবারের সদস্যরা।
কিশোরীটির মা সুলতানা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুই মাস আগে আমার মেয়ে মার্কেটে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়। পরে আর ফিরে আসেনি। আমরা খোঁজাখুজি করেও তাকে পাইনি। এক সপ্তাহ আগে আমার কাছে ভারতীয় নম্বর থেকে ফোন আসে। ফোনের ওই প্রান্ত থেকে ভারতীয় এক লোক আমাকে জানায় যে, আপনার মেয়েকে একটি মহিলা ভারতে এনে পতিতালয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। আপনার মেয়ে বলেছে যে, একটি ছেলের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো, সেই ছেলের মা তাকে ভারতের পতিতালয়ে বিক্রি করতে চেয়েছিল। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করেছি। সে এখন আমাদের হেফাজতে আছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের সাথেও ফোনে কথা হয়েছে। সে বলেছে যে, মা আমাকে তুমি বাঁচাও। ওই ছেলে এবং ছেলের মা ছলনা করে আমাকে ভারতে নিয়ে এসেছে। যেভাবেই হোক আমাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসো। মেয়ে আকুতি করলেও আমি তাকে কিভাবে দেশে ফিরিয়ে আনবো। আমার কাছে টাকাও নেই। আমি গার্মেন্টসে চাকুরী করি। আমি স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে জানিয়েছি। সরকার ও প্রশাসনের কাছে আমার আবেদন, আমার মেয়েকে যেন সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।’
এদিকে, দূতাবাসের কর্মকতারা জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় কাজগপত্রের মাধ্যমে কিশোরীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বলেন, গলাচিপা এলাকার রাবেয়া আক্তার মুক্তা গত ১৮ রমজান থেকে নিখোঁজ ছিলো। নারায়ণগঞ্জে তাকে অনেক খোঁজাখুজি করা হয়। থানায় জিডিও করা হয়েছে। গত ৫ই মে ভারতের দিল্লি থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ফোন করে মেয়েটির অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ করে। তার অভিভাবক আমার কাছে আসলে আমি তার সাথে কথা বলি। কর্মকর্তার বরাতে আমরা জানতে পারি, মেয়েটিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে নাঈম নামে এক ছেলে তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায় এবং ছেলেটির মায়ের হাতে তুলে দেয়। তার মা একজন পেশাদার নারী পাচারকারী। এই মহিলা তাকে নিয়ে চোরাই পথে রাজস্থানে চলে যায়। রাজস্থানের জয়পুর পুলিশ ঘটনাক্রমে তাকে গ্রেফতার করে। মেয়েটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় তাকে একটি সেল্টার রুমে রাখা হয়েছে। আর ওই নারী পাচারকারী এখন সেখানকার জেলে আছে। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছে, আমরা জিডির কপি এবং মেয়ের নাগরিকত্বের কাগজপত্র যথাযথ ভাবে প্রদান করলে তারা মেয়েটিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবে।
এদিকে, ভারতে অবস্থানরত কিশোরীর এমন ঘটনা শুনে তাকে ফিরিয়ে আনতে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা পাওয়ার বিষয়ে জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এমন ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট থানায় প্রথমে জিডি করতে হবে। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে মানবপাচারকারী বিরোধী একটি কমিটি আছে, সেখানে অভিযোগ বা আবেদন করার পর যেসকল সহযোগিতা লাগে তা থানা এবং ওই কমিটির মাধ্যমে পাওয়া যাবে। এছাড়াও বেসরকারী ভাবে ব্র্যাক এই মানবপাচারের শিকার ভিকটিমদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কাজ করে। তাই পরিবারটির উচিৎ তাদের সাথে যোগাযোগ করা।
এদিকে ভারতে থাকা ওই কিশোরীকে ফিরিয়ে আনতে পুলিশও সব ধরনের সহযোগিতা করবে বলে জানান পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল। তিনি বলেন, ‘মেয়েটির পরিবারের সদস্যরা আমাদের কাছে আসলে আমরা তাকে সঠিক উপায়ে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবো।’ তিনি বলেন, ‘সন্তানের বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। তার মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, সেসব বিষয়ে খোঁজ খবর ও তদারকি করতে হবে।’
এদিকে, ভারত থেকে ওই কিশোরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রা।