স্টাফ রিপোর্টার :
অট্টালিকার শহরে রূপ নিয়েছে নারায়ণগঞ্জ। ইমারত আইনের তোয়াক্কা না করে অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠা এসব অট্টালিকা যেন একেটি মরণ ফাঁদ। যেকোনো সময়ে একেকটি ভবন পরিণত হতে পারে জলন্ত চিতায়! যেমনটা হয়েছে ঢাকার বেইলী রোডের বহুতল ভবনটিও। ওই ভবনের মতই নারায়ণগঞ্জে রয়েছে অসংখ্য বহুতল ভবন। আবাসিক নকশায় গড়ে তোলা এই ভবনর মালিকরা অনিয়মের মাধ্যমে তা বাণিজ্যিক ভবনে পরিণত করেছেন। পুরনো ভবনের ফ্লোর ভাড়া নিয়ে সাজ সজ্জার প্রলেপ লাগিয়ে বসানো হয়েছে অভিজাত হরেক রকম রেস্টুরেন্ট। এর মধ্যে শহরের চাষাড়া শহীদ মিনার ঘেষা ভাষা সৈনিক সড়কের পাশে অবস্থিত মনির টাওয়ার এবং পাশর্^বর্তী ৮ তলা ভবনে সুলতান ডাইনসহ পুরোটাই বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ঠাসা। এসব রেস্টুরেন্টগুলোর চুলোয় আগুন জ¦ালাতে ব্যবহৃত হচ্ছে এলপিজি তথা গ্যাসের সিলিন্ডার। যেকোনো দূর্ঘটনায় এই গ্যাস সিলিন্ডার একেকটি বোমায় পরিণত হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই বেইলী রোডের মত নারায়ণগঞ্জের এই ভবনগুলো জ¦লন্ত চিতায় রূপ নেয়ার আগেই দায়িত্বশীলদের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন সচেতন মহল।
জানা গেছে, বহুতল ভবন নির্মাণে অবকাঠামোগত সুবিধা, পার্কিং স্পেস, অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করণে ফায়ার এক্সিট সহ ১০টি নিয়ম মানার কথা রয়েছে ইমারত আইনে। যা বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব এখন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউকের উপর। তবে রাজউকের কাজে কর্মে বেড়িয়ে এসেছে শুভঙ্করের ফাঁকি। ভবন যত বড় হয়েছে, অনিয়মের মাত্রাটাও যেন বেড়েছে ততটাই।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, শহরে ক’টি ভবন বিল্ডিং কোড মেনে তৈরী হয়েছে আর ক’টি ভবন নকশা বর্হিভূত এর সঠিক হিসেব জানে না নারায়ণগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজউক কর্মকর্তা! শুধু কী তাই? বিল্ডিং কোডের আইনে বলা থাকলেও এই শহরের প্রধান সড়কগুলোর পাশে গড়ে উঠা সিংহভাগ অট্টালিকাতে রাখা হয়নি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। ফায়ার এক্সিট সহ অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়নি ভবনগুলোতে।
তবে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করণের বিষয়টি তদারকি করার দায়িত্ব ফায়ার সার্ভিসেরই। ফায়ার সার্ভিস কর্তারা যেন দেখেও দেখছেন না কিছুই! তাদের নমনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন নতুন নয়। বড় কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে সাময়ীক তোড়জোড় দেখা গেলেও অগ্নিঝুঁকিপূর্ন ভবনগুলোতে তাদের মনিটরিং কিংবা ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই- এমনটা বলছেন সচেতন মহল।
এদিকে, রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের মাঝে পরিকল্পনার দিক থেকে সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে মোটা দাগে। দেখা দিয়েছে নিয়ম-নীতি বা আইন প্রয়োগের উদাসীনতাও।
তথ্য মতে, নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠা বহুতল ভবনগুলো যেমন রাজউকের নকশা-নিয়ম মেনে তৈরী হয়নি, তেমনই এসকল ভবনে ফায়ার এক্সিট বা ইমার্জেন্সি সিঁড়ির ব্যবস্থা না থাকা সত্যেও নীরব রয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্তারা।
সচেতন মহল বলছে, ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল প্রতিটি আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে তদারকি করার বিকল্প নেই। কেননা, এক প্রতিষ্ঠানের সাথে আরেক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতা এবং তদারকির অভাবের কারণেই ভবন মালিকরা নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক কর্মকর্তা দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেছেন, ‘২০০৩ সালে একটি আইন হয়েছে যে, ২৩ মিটার বা ৬ তলার উপরে ভবন করতে হলে ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি লাগবে। কিন্তু রাজউকের আবার নতুন আইন হয়েছে যে, ৩৩ মিটার বা ১০ তলার উপর থেকে হলে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র লাগবে। অর্থাৎ তাদের আইনে আছে ১০ তলার উপরে ভবন করতে হলে ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন লাগবে। কিন্তু আমাদের আইনে আছে সাত তলা। অথচ, আমাদের ৭ তলার আইন ২০০৩ সালে হওয়ার পর রাজউকের এই নতুন আইন হয়েছে। এখানে দুটি ডিপার্টম্যান্টে আইনী ভাবেই সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। এছাড়া, যখনই ভবন বা গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, তখনই যদি আমাদের কাছে আসতো, তাহলে ফায়ার প্ল্যানটা বাস্তবায়ন করা যেত। কিন্তু ফায়ার প্ল্যান্ট ছাড়াই শিল্প কারখানা সহ বহুতল ভবন করা হচ্ছে।’
এদিকে, সমন্বয়হীনতার বিষয়টি যেমন স্পষ্ট, তেমনই কর্মকর্তাদের নীরবতাও বেশ রহস্যজনক। অভিযোগ রয়েছে, নারায়ণগঞ্জের অট্টালিকার মালিকরা বেশ ক্ষমতাধর। অনেকের আবার রাজনৈতিক পরিচয়ও রয়েছে। কেউ কেউ আছেন জনপ্রতিনিধিও। যেমন শহরের সবচেয়ে বহুতল ভবন ২৪ তলা বিশিষ্ট টোকিও প্লাজার মালিক হলেন ফজর আলী। বর্তমানে তিনি গোগনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পা বাড়ানো ফজর আলীর সাথে নারায়ণগঞ্জের এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের নেতা ও সংসদ সদস্যের দহরম মহরম সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রশ্ন উঠেছে, এতেই কী নিয়ম-নীতি প্রয়োগে বিপত্তি বেধেছে টোকিও প্লাজার ক্ষেত্রে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শুধু টোকিও প্লাজাই নয় বরং মার্ক টাউয়ার থেকে শুরু করে প্রায় সবকটি ভবনই অগ্নিঝুকিপূর্ন। ভবনগুলোতে নেই ইমার্জেন্সি এক্সিট বা বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা।
এই বিষয়ে রাজউক-৮ (নারায়ণগঞ্জ জোন) এর পরিচালক ইয়াহ হিয়া খান দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘২০০৮ সালের বিধির মধ্যে যেসকল ভবন হয়েছে, সেসব ভবনে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখন কোন ভবন কোন বিধিমালাতে হয়েছে সেটা নির্দিষ্ট বিল্ডিংয়ের নকশা দেখলে বুঝা যাবে। আমরা মনিটরিং করছি। পার্কিং স্পেস বর্হিভূত এবং বিল্ডিং কোড না মানা ভবনগুলো সনাক্ত এবং প্রতিবেদন করছি। মালিকদের নোটিশ করে যাচ্ছি। আমাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জানাচ্ছি। তারা যদি অভিযানে যেতে বলে তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ তবে কতগুলো ত্রুটিযুক্ত ভবন সনাক্ত এবং কতগুলোতে অভিযান হয়েছে, এর সঠিক তথ্য জানাতে পারেননি ওই কর্মকর্তা।
এদিকে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবীদ মো. মঈনুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেছিলেন, ‘নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি এবং নকশা সহ বিধিমালার বিষয়টি সম্পূর্ন তদারকি করবে রাজউক। এখানে সিটি করপোরেশনের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু রাজউক যথাযথ তদারকি করে না। নগরীতে এমন একটিও বিল্ডিং নেই যেখানে রাজউকের নকশা মেনে হয়েছে। তারা নকশার অনুমোদন দিচ্ছে কিন্তু একটা বিল্ডিংও তদারকি করছে না, নিয়ম মাফিক হচ্ছে না। এর ফলে নগরী আরও অপরিকল্পিত হয়ে যাচ্ছে।’
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক মো. ফখরউদ্দিন আহাম্মদ বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে কোন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করা হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে আমরা মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রতি শনিবার রুটিন ওয়ার্ক করি। যেখানেই আগুন লাগুক, আমাদেরই ভূমিকা রাখতে হবে। অন্যকেউ তো আর আসবে না। নারায়ণগঞ্জের পুরাটাইতো হেজার্ড। কেউ তো কথা শুনেনি। ২৪ তলা ওয়ালাও শুনেনি অন্যারাও শুনে না। বাংলাদেশের লোকজন তো কোনো আইনই মানে না। আমরা জীবন দিয়ে হলেও চেষ্টা করে থাকি। আমাদের কাজটা আমরা করে যাবো। মানুষ যদি নিজে থেকে ভালো না হয়, আমরা কাউকে জোর করে ভালো করতে পারবো না। সবার নিরাপত্তা সবার নিশ্চিত করতে হবে। আমার নির্দিষ্ট জনবল রয়েছে। এই জনবল হলো আগুন নেভানোর মত জনবল।’