আজ সোমবার, ১২ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত শীতলক্ষ্যা


মোঃ আব্দুল্লাহ খান মুন্না ( নির্বাহী সম্পাদক ) ঃ নদীর তীরে বসবাস । বাড়ি থেকে শোনা যেতো স্টিমার , ট্রলারের আওয়াজ।নদী ছিল এ অঞ্চলের মুল চালিকা শক্তি। নদীকে ঘিরে গড়ে উঠে শহর , বন্দর,কলকারখানা।শৈশবে সময় পেলেই পড়ার ফাকে ছুটে যেতাম নদীর পাড়ে । ছোট ছোট মাছ নদীর পাড়ে ছোটা ছুটি করত, ধরার চেষ্টা করতাম খালি হাতে ।বন্ধুদের নিয়ে যখন তখন গোসল করতাম নদীতে। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় মাছ ধরত স্থানীয় জেলেরা ।অবাক নয়নে চেয়ে থাকতাম কখন একটি হুম মাছ নদীতে ঝাপটি মারবে ।

শীতলক্ষ্যা নদী বা লক্ষ্ম্যা নদী বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ১০৮ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ২২৮ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক শীতলক্ষ্যা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নং -৫৫

এই নদীটি ব্রক্ষ্মপুত্রের একটি উপনদী। এর গতিপথের প্রাথমিক পর্যায়ে এটি দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পরে নারায়ণগঞ্জের পূর্ব দিয়ে কালাগাছিয়ার কাছে ধলেশ্বরী নদীর সাথে মিশেছে। এর উপরিভাগের একটি অংশ বানর নদী নামে পরিচিত। নদীটি প্রায় ১১ কিলোমিটার লম্বা এবং নারায়ণগঞ্জের নিকটে এর সর্বোচ্চ প্রস্থ প্রায় ৩০০ মিটার। এর সর্বোচ্চ প্রবাহ ডেমরার কাছে ২,৬০০ কিউসেক।সারা বছর ধরে এর নাব্যতা বজায় থাকে।

কিন্তু আজ নদীটি মৃত প্রায় । দুররোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর মতো ক্ষত বিক্ষত তার শরীর । এক সময় খরস্রোতা এ নদী আজ ময়লা আবর্জনার ভাগার । এক সময় এই নদীর পানি দিয়ে ঘর-বাড়ির দৈনন্দিন কাজ করা হতো আজ সেই একই নদীর পানির কাছেই যাওয়া যাচ্ছেনা পচা গন্ধে। মাছের প্রজনন ক্ষমতা হারিয়েছে অনেক আগেই তাই এ নদীতে মাছ নেই বললেই চলে।

শহরায়ন আর শিল্পয়ানের প্রভাবে শীতলক্ষ্যা নদী হারিয়েছে তার নাব্যতা। হাজার হাজার টন শিল্পকারখানার ব্জ্র পদার্থ আর অপরিশোধিত পানি নদীর জলকে করেছে দুষিত। তাছাড়া ঢাকা শহরের সকল ব্জ্র এসে পড়ছে শীতলক্ষ্যা নদীতে।নদী দূষণ কমাতে ৬ জানুয়ারি ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ বর্জ্যবিরোধী অভিযান শুরু করেছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ ।পরে তার আর তেমন অগ্রগতি হয় নি। মানুষের স্বাস্থ্য এখন হুমকির সম্মুখীন। দূষণের ফলে ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর।
অন্যদিকে নদীর তীর বা আশপাশের বসবাসকারি লোকজন গোসল, রান্নাবান্নাসহ বিভিন্ন কাজে নদীর পানি ব্যবহার করায় ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে।

তাই নদী রক্ষায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের সমন্বয়ের আবশ্যকতা বোধ করছি। বলাবাহুল্য, নদী দখল ও দূষণ রোধে সরাসরি দায়িত্ব প্রায় ১৫টি মন্ত্রণালয়ের। পরিবেশ অধিদফতরের কাজের আওতায় রয়েছে নদীর পানি দূষণ রোধ করা। বিআইডবিউটিএর দায়িত্ব তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা। নদীর পানির কর্তৃপক্ষ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, তলদেশের কর্তৃপক্ষ ভূমি মন্ত্রণালয় এবং পাড়ের মালিক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সেখানে যে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে গেলেই দ্বারস্থ হতে হয় পরিকল্পনা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের। আর দখলমুক্ত রাখতে প্রয়োজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় ভূমিকা। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়ের অভাবে নদী দখল এবং দূষণ কোনোটাই রোধ করা যাচ্ছে না। নদী দূষণের পরিণতিতে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিও জরুরিভাবে আমলে নেয়ার দাবি রাখে। প্রতিদিন ক্রোমিয়াম, পারদ, ক্লোরিন, নানা ধরনের এসি দস্তা, নিকেল, সিসা, ফসফোজিপসাম, ক্যাডমিয়াম, লোগাম অ্যালকালি মিশ্রিত বর্জ্যরে কারণে নদীগুলো প্রায় মাছশূন্য হয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষ পরিবেশ দূষণের শিকার হয়ে জন্ডিস, ডায়রিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, মূত্রনালী ও কিডনি, চর্মরোগসহ ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। এসব নদীর পানি ব্যবহারকারী বেশিরভাগ মানুষই চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

শীতলক্ষ্যা নদী এখন অসুস্থ ও মৃতপ্রায়, এর নাব্য ফিরিয়ে আনতে পুনরায় খননের বিকল্প নেই। শীতক্ষ্যা নদীকে বাঁচাতে সকলকে সচেতন হতে হবে। যেহেতু পানির আরেক নাম জীবন সেহেতু আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে দূষণমুক্ত নদী, এমনকি শহরকে বসবাসের উপযোগী করে তুলতে নদী বাঁচিয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা যেতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের কার্যকর ভূমিকা আরও গতিশীল হতে হবে। কঠিন বর্জ্য পদার্থ পানিতে মিশতে দেওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। মানববর্জ্য ব্যবস্থার জন্য আলাদাভাবে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান করতে হবে। সড়ক সম্প্রসারণের নামে ইচ্ছামতো বাঁধ দিয়ে খালের ওপর সড়ক নির্মাণ করা যাবে না। খালগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। ঢাকার জলাশয়গুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।

নদীকে দূষণমুক্ত করতে হলে সরকারের পাশাপাশি আমাদের দেশের সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। আইন করে দেশের কোনো সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব না। আইনের প্রতি আমাদের সকলকে শ্রদ্ধা দেখিয়ে আগে আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের কিছু সংখ্যক লোকের অবহেলার জন্য সকল মানুষ যন্ত্রণা ভোগ করুক তা হতে পারে না। নদ-নদী পরিষ্কার ও পরিছন্ন রাখা আমার, আপনার, সকলের দায়িত্ব।