আজ রবিবার, ১৭ই ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১লা সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

জলে ক্ষোভ, কারায় সহমর্মিতা

সংবাদচর্চা রিপোর্ট :

নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী তারা দুজন। একজন শামীম ওসমান অন্যজন গিয়াসউদ্দিন। এই দুই রাজনীতিকের মধ্যে একজনের প্রতি মানুষের ক্ষোভ যেমন বাড়ছে অন্যজনের প্রতি বাড়ছে সহমর্মিতা। তাদের একজন কারাবন্দি অন্যজন উন্মুক্ত। একজন ক্ষমতাহীন অন্যজন ক্ষমতাসীন। এই দুই নেতার মধ্যে একজনের প্রতি যারপরনাই ক্ষুব্ধ ফতুল্লার পানিবন্দি লাখো মানুষ। অন্যদিকে আরেকজনের প্রতি সাধারণ মানুষের সহমর্মিতা বেড়েছে বহুগুণ।
জেলার পাঁচটি আসনের মধ্যে বরাবরই আলোচনার শীর্ষে থাকে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন। এই আসন নিয়ে মানুষের আগ্রহ একটু বেশিই থাকে। বর্তমানে এই আসনের সাংসদ শামীম ওসমান। তাকে দেশের একজন প্রভাবশালী সাংসদ হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে। দেশব্যাপিও তিনি বেশ আলোচিত, পরিচিত মুখ।
১৯৯৬ সালে শামীম ওসমান এই আসন থেকে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা এই নেতার চোখে চোখ রেখে কথা বলা কিংবা সামনাসামনি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার লোক এখানে তেমন একটা নেই বললেই চলে। এমন একজন নেতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তাকে হারানোটাও সহজবোধ্য নয়। কিন্তু সেই অসাধ্যকেই সাধন করেছিলেন মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন। ২০০১ সালে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত শামীম ওসমানকে হারিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত সাংসদ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন গিয়াসউদ্দিন। সেসময় তাকেও একজন প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় এমপি ধরা হতো।
রাজনীতির মাঠে শামীম ওসমানের বিপক্ষে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরা হয়ে থাকে মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনকে। তাদের দুজনের সম্পর্কটাও সাপ আর নেউলে। অনেক সময় শোনা যায় বিএনপির কোনো কোনো নেতা শামীম ওসমানের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতিতে টিকে আছেন। অথবা প্রভাবশালী এই সাংসদের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করে চলেন। তবে গিয়াসউদ্দিনের ক্ষেত্রে এমন আলোচনা কখনই উঠেনি। বরং শামীম ওসমানের সঙ্গে সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিনের মধ্যে কখনই কোনো রকম আঁতাত হবে না বলেই মনে করেন রাজনৈতিকাঙ্গনের নেতাকর্মীরা।
তারা মনে করেন, একসময় খেলার মাঠে আবহনী আর মোহামেডান যেমন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, দুই দলের সম্পর্ক ছিল বৈরি। তেমনি নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির মাঠে শামীম ওসমান ও মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের সম্পর্ক। তাদের এই বৈরি সম্পর্কের বরফ কখনই গলবার নয়। ফলে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের রাজনীতিতে এই দুই নেতাকে ঘিরে প্রায় সময় শোনা যায় নানা ধরণের আলোচনা। এসব আলোচনায় বেশিরভাগ সময়ই থাকে কার থেকে কে বেশি জনপ্রিয়, নির্বাচনে এই দুজন যদি আবারও মুখোমুখি হোন তাহলে কে জয়ী হতে পারেনÑ এমন সব কৌতুহল থাকে মানুষের মাঝে।
শামীম ওসমান অপেক্ষায় গিয়াসউদ্দিন বেশি জনপ্রিয়, তারা যদি ফের ভোটের মাঠে মুখোমুখি হোন তাহলে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হবে বলেই মনে করছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। শামীম ওসমানের বিপক্ষে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গিয়াসউদ্দিনের বিকল্প নেই বলে মনে করা হয়ে থাকে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও তেমনটিই মনে করেন। তাছাড়া গিয়াসউদ্দিন জেলা বিএনপির দায়িত্বে আসার পর থেকে এখানকার বিএনপিও বেশ উজ্জীবিত। পুনঃশক্তি নিয়েই বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে ক্ষমতার বাইরে থাকা এই দলের নেতাকর্মীদের। আর সেটি সম্ভব হচ্ছে গিয়াসউদ্দিনের নেতৃত্বের গুণেÑ এমনটাই মনে করেন বিএনপি দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে অন্য দলের নেতাকর্মীরাও।
তারা মনে করেন, নানা কারণেই বর্তমান সাংসদ শামীম ওসমানের তুলনায় সাবেক সাংসদ মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছেন। রাজনীতিতেও তিনি একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে সবার কাছে বেশ পরিচিত। এছাড়া রাজনীতির বাইরেও মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের আলাদা একটি অবস্থান রয়েছে যা সার্বজনীন। তিনি শিক্ষা খাতেও বিশেষ অবদান রাখছেন। একজন শিক্ষা অনুরাগি হিসেবে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে তার আলাদা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তিনি একটি কলেজ ও বেশ কয়েকটি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি মসজিদ ও মদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জেলার মধ্যে বেশ সুনামের সঙ্গেই শিক্ষাদান করে আসছে। যা প্রতিবছরই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেধাভিত্তিক শিক্ষাদানে সুনাম বয়ে আনছে।
মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন বর্তমানে কারবন্দি রয়েছেন। সর্বশেষ তাকে ১২টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। বর্তমান সর্বমোট ১৪ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কেরানীগঞ্জ করাগারে বন্দি রয়েছেন সাবেক এই সাংসদ। সহসা তিনি যেন কারামুক্ত না হতে পারেন সেজন্য একটি মহল পর্দার আড়াল থেকে কলকাঠিও নেড়ে যাচ্ছেন। এই মহলটির মধ্যে গিয়াস ভীতি কাজ করছে। তবে, মুক্ত গিয়াসউদ্দিনের তুলনায় কারাবন্দি গিয়াসউদ্দিনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেই মনে করেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে একজন ৭৪ বছর বয়সের মুক্তিযোদ্ধার হাতে হাতকড়ায় সাধারণ মানুষের সহমর্মিতাও তার পক্ষে যাচ্ছে।
অপরদিকে বিগত তিন মেয়াদে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য হয়েও নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারছেন না শামীম ওসমান। তার প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভের অন্ত নেই। অনেকদিক থেকেই তিনি ব্যর্থ হচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়াও তার দেয়া প্রতিশ্রুতি তিনি রাখতে পারছেন না বলে মনে করা হচ্ছে। এসব কারণে দিনদিন তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তারা বলছেন, শামীম ওসমানের প্রতি সব থেকে বেশি ক্ষুব্ধ ফতুল্লা অঞ্চলের মানুষ। এই অঞ্চলের মানুষকে বছরের পর বছর আশ^াস দিলেও জলাবদ্ধতার হাত থেকে মুক্তি দিতে পারছেন না বর্তমান এই সাংসদ। এছাড়াও সন্ত্রাস, মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে মক্কায় গিয়ে ভিডিও বার্তা দিয়েও সেই বার্তার বাস্তবায়ন এখনও পর্যন্ত তিনি করতে পারেননি। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন করতে না পারাটাকেও তার ব্যর্থতা বলেই মনে করেন অনেকে। মূলত এসব কারণে তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে গিয়াসউদ্দিনকে একের পর এক মামলায় অন্তর্ভূক্ত করার নেপথ্য ইন্ধদাতা বা নির্দেশদাতা হিসেবে বর্তমান সাংসদ শামীম ওসমানকেই মনে করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। শুধু গিয়াসউদ্দিনকেই নন, তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকেও মামলার পর মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করার পেছনের ব্যক্তি হিসেবে বর্তমান এই সাংসদকেই দুষছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
তাদের অভিযোগ, বর্তমান সাংসদ কোনোভাবেই চাননা গিয়াসউদ্দিন মুক্তভাবে রাজনীতি করুক। কেননা, তিনি যদি মুক্তভাবে রাজনীতি করার সুযোগ পান তাহলে তার রাজনীতির দক্ষতার কাছে কিছুতেই কুলোবেন না তিনি। মূলত এমন চিন্তা থেকেই সাবেক এই সাংসদকে মামলার পর মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে তারা দাবি করেন।
তারা বলেন, গিয়াসউদ্দিন এমনই একজন দক্ষ ও জনপ্রিয় ব্যক্তি যা তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে প্রমাণ দিয়েছেন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলে কখনই আওয়ামী লীগ ব্যাতিত বিএনপি ভোটে জয়ী হতে পারেনি। কিন্তু ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গিয়াসউদ্দিনের জনপ্রিয়তায় এবং দক্ষতায় ওই অঞ্চলে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিল। এছাড়াও দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে, অসংখ্য মামলার আসামি হয়েও গিয়াসউদ্দিন নিজ এলকা ছেড়ে যাননি। মামলা মোকাদ্দমা মোকাবেলা করেই তিনি নিজ এলাকাতেই থেকেছেন। যা সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহযোগ্যতা অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মতে, দলের এমন দুঃসময়ে গিয়াসউদ্দিন সাহসের বাতিঘর হিসেবে কাজ করছেন। তার সাহসেই সাহসী হয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা মাঠে নামছেন। কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকছেন।
এদিকে গিয়াসউদ্দিনের মামলা সম্পর্কে তার আইনজীবী ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেছেন, ‘তার (গিয়াসউদ্দিন) বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রতিটি মামলায় মিথ্যা, বানোয়াট ও সাজানো। তাকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই এসব মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে।’
অন্যদিকে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু বলেছেন, ‘গডফাদারের প্রতিহিংসার শিকার গিয়াসউদ্দিন সাহেব। যেহেতু উনি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন এবং একজন দক্ষ সংগঠক তাই নারায়ণগঞ্জের গডফাদাররা প্রতিহিংহার বশে তার বিরুদ্ধে এতগুলো মামলা করেছে। প্রত্যেকটি মিথ্যা এবং গায়েবি মামলা।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি বলেছেন, ‘গিয়াসউদ্দিন সাহেব একজন দক্ষ সংগঠক। তার দক্ষ নেতৃত্বের কারণে এখানকার বিএনপি পুনর্জীবিত হয়েছে। যার কারণে গডফাদারের চক্ষুশূলে পরিণিত হয়েছেন তিনি। গডফাদার চায় না গিয়াসউদ্দিন সাহেব মুক্ত থাকুক। যার কারণে তাকে একের পর এক মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। তবে একজন মুক্ত গিয়াসউদ্দিনের তুলনায় কারাবন্দি গিয়াসউদ্দিন অনেক বেশি শক্তিশালী যার প্রমাণ মিলছে আদালত পাড়াতেই।’

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ