আজ শনিবার, ২৪শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

গিয়াস ইস্যুতে সরব বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার :
সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিনকে কারাগারে পাঠানোয় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন বিএনপির নীতি-নির্ধারনী পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের বিএনপি এবং অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরাও তার মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদ মিছিল সহ লিফলেট বিতরণ এবং দেয়ালে দেয়ালে পোষ্টার সাঁটিয়েছেন। এমনকি নারায়ণগঞ্জ জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের পক্ষ থেকেও জেলা বিএনপির এই সভাপতির কারামুক্তি দাবি করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন। তার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে দলটির নেতাকর্মীরা। গিয়াস অনুসারীদের দাবি, তাকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে তার বিরোধী মহল পর্দার আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। এর মাধ্যমে গিয়াস উদ্দীনকে ঘায়েল করার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপিকে দূর্বল করে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ গিয়াস অনুসারীদের।
জানা গেছে, কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে খ্যাতি রয়েছে জেলা বিএনপির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দীনের। সাবেক এই সংসদ সদস্য জেলা বিএনপির নেতৃত্বে আসার পর রাজপথে শক্ত অবস্থানে দেখা গিয়েছিল নেতাকর্মীদের। কথিত আছে, তিনি নেতৃত্বে আসায় বিএনপির ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীরাও উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন। ফলে জেলা বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে নেতাকর্মীদের ঢল দেখা যেত।
এদিকে, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের বর্তমান প্রভাবশালী এমপি শামীম ওসমানের সাথে গিয়াস উদ্দিনের সম্পর্কের ফাঁটল দীর্ঘদিনের। এক সময় দু’জন একই দলের রাজনীতি করলেও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে গিয়াস উদ্দিন বিএনপি থেকে মনোনিত হয়ে শামীম ওসমানকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছিলেন। পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে তারা একে-অপরের বিরুদ্ধে ভোটে না লড়লেও মাঠের বাহিরের রাজনীতিতে ছিলেন চির প্রতিদ্বন্দ্বী। গত জাতীয় নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও শুরুর দিকে ধারনা করা হচ্ছিল, বিএনপি নির্বাচনে এলে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে শামীম ওসমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন গিয়াস উদ্দিন। ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গিয়াস বিরোধী নানা বক্তব্য দিয়ে আলোচনা তুঙ্গে রেখেছিলেন শামীম ওসমান।
গিয়াস অনুসারীরা বলছেন, গিয়াস বিরোধী মহলটি পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ায় তার বিরুদ্ধে দূর্নীতির মামলা দিয়ে তাকে কারাবন্দি করা হয়েছে। তাদের মতে, প্রায় ১৬ বছরের পুরনো সম্পদের হিসেব নিয়ে ২০২১ সালে মামলা রুজু করা হয়েছে, যা পরিকল্পিত বলেও মন্তব্য করছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাকর্মীরা।
এই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, গিয়াস উদ্দিন সাহেব নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ^াসী। কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী রাজনীতি করার ক্ষেত্রে সরকার যেই সংকোচনবৃত্তি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সেই সংকোচণবৃত্তি বাস্তবায়নের পদক্ষেপের অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের গ্রেফতার এবং মামলা মোকদ্দমা দিয়ে হয়রানী করা হচ্ছে। আমি মনে করি, গিয়াস উদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধে যেসকল মামলা, সেগুলোও একই ধরনের প্রচেষ্টা। বিরোধী রাজনীতি করার করণেই তাকে মামলা দিয়ে হয়রানী করা হচ্ছে। আমরা এর তিব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। একই সাথে অবিলম্বে তার মুক্তির দাবি জানাচ্ছি।’
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘সরকার বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য বিএনপির জনপ্রিয় নেতাদেরকে দূর্বল করতে সাজানো ও ষড়যন্ত্র মূলক মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগার ভরে রেখেছে। জেলা বিএনপির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনকেও একই ভাবে ষড়যন্ত্র মূলক মামলায় সাজানো চার্জশীট দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের এমপি শামীম ওসমানকে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে সরকার দলীয় প্রভাবশালী এক নেতা রয়েছে, তিনি সরকারকে যা বুঝাবে, সরকার তাই বুঝবে। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপিকে দূর্বল করতে হলে কাকে ধরতে হবে, তা তো সেই নেতা নিজেই জানে। গিয়াস উদ্দিন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি ছিলেন। এই আসনে বিএনপি থেকে তারই মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই এই আসনের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের এমপি তো চাইবেই তার পথের কাঁটা সরানোর জন্য। আমরা মনে করি সেটাই করা হয়েছে।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজীব দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘আমরা যারা বিএনপি করি, তারা সবাই মিথ্যা মামলার শিকার। এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট। ম্যাক্সিমাম মামলা সরকার প্ররোচিত হয়ে দায়ের করে। দুদকের মামলায় জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন আদালতে জামিন নিতে গেলে তার জামিন নামঞ্জুর করা হয় এবং তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। আসলে সরকার দলীয় লোকাল নেতারা সর্বদা তাদের প্রভাব খাটিয়ে গেছে। বিগত সময়েও এগুলো হয়েছে, এখনো হচ্ছে।’
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সভাপতি মো. মাজেদুল ইসলাম দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘গিয়াস উদ্দিন সাহেব শুধু একজন সাবেক এমপিই নয় বরং তিনি এই দেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বিএনপির রাজনীতিতে নারায়ণগঞ্জে যেই সাহসিকতার দৃষ্টান্ত রেখেছেন, আমরা মনে করি সেই কারণেই ক্ষমতাসীন দলের কিছু ব্যক্তির মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এই কারণেই তাকে দুদকের মামলা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে মামলার নামে হয়রানী করাটা মোটেও কাম্য নয়।’
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সাধারন সম্পাদক ও নাসিক ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ইকবাল হোসেন দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘গিয়াস উদ্দিন সাহেব রাজতৈনিক প্রতিহিংসার শিকার। তিনি উচ্চ আদালতে এই মামলার জামিন পেয়েছেন। নিয়মানুসারে তিনি ঢাকার নিম্ন আদালতে স্থায়ী জামিনের জন্য আবেদন করলেও তাকে জামিন না দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে করানো হয়েছে।’
ফতুল্লা থানা বিএনপির সহ-সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘গিয়াস উদ্দিন সাহেবকে মামলা দিয়ে কারাগারে রাখা গেলেই নারায়ণগঞ্জে বিএনপিকে দূর্বল করা যাবে- এমন ধারনা থেকেই সরকার এবং সরকারী দলের নেতারা এই নিন্দনীয় কাজ করিয়েছে বলে আমরা মনে করি। আমরা এর তিব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফতুল্লা থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রুহুল আমিন শিকার দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘জেলা বিএনপির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তার সম্পত্তি নিয়ে মামলায় দুদক যা উল্লেখ করেছে, তা দেখেছি। মামলায় উল্লেখিত তার সকল সম্পত্তি বহু আগের। কিন্তু ২০২১ সালে এই মামলাটা তারা রুজু করেছে। আমি মনে করি, উদ্দেশ্যমূলক ভাবে এটা করা হয়েছে। এখানে স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বেরও কিছু বিষয় রয়েছে। তাকে বিএনপির রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনে যেন অংশগ্রহণ করতে না পারে, সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই মামলাটা করানো হয়েছে বলে আমরা মনে করি। মূখ্য উদ্দেশ্য ছিলো যে, বিগত নির্বাচনে যেন তিনি প্রার্থী হতে না পারেন এবং তাকে যেন আটকে রাখা যায়।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সম্মানিত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনকে শুধু মাত্র আন্দোলন সংগ্রাম থেকে দূরে রাখা এবং আন্দোলন সংগ্রামগুলোকে প্রতিহত করার জন্য মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলার তথ্য অনুযায়ী এটা প্রায় ১৭ বছর আগের ঘটনা। এই ১৭ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতায় নেই। তাহলে গিয়াস উদ্দিন সাহেব এই ১৭ বছরে কী দুর্নীতি করবে! আমি মনে করি, বর্তমান সরকারের নেতারা গিয়াস উদ্দিনের রাজনৈতিক দক্ষতাকে ভয় পায় বিধায় তাকে মামলা দিয়ে বন্দি করে রাখা হয়েছে।’
এদিকে, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার সহ প্রায় প্রতিটি থানা এলাকায় নেতাকর্মীরা গিয়াস উদ্দিনের মুক্তির দাবিতে নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে সরব হয়েছেন।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির দায়িত্ব পেয়েই খাদের কিনারায় ধুকতে থাকা নারায়ণগঞ্জ বিএনপিকে টেনে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। অভ্যন্তরীন কোন্দল ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি যখন সাংগঠনিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছিল, তখন কেন্দ্রীয় নেতারা গিয়াস উদ্দিনের প্রতি আস্থার সাথে যেই দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব পালনে কার্পন্যতা করেননি তিনি। তার নেতৃত্বগুণ ও প্রচেষ্টায় দীর্ঘ ১৫ বছর পর নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সম্মেলন হয়েছে। রাজপথেও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল স্থানীয় বিএনপি নেতারা। এছাড়াও, নারায়ণগঞ্জের ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী এমপি শামীম ওসমানের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস এই জেলায় গিয়াস উদ্দিন দেখিয়েছেন। সাহস জুগিয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝেও। যা ইতিপূর্বে জেলা বিএনপির অন্যান্য নেতাদের কেউ-ই পেরে উঠেনি। উপরন্ত গুঞ্জন উঠেছিল, ইতিপূর্বে যারা জেলা বিএনপির নেতৃত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের ওই প্রভাবশালী এমপির সাথে গোপনে আঁতাত করে চলেছিলেন। তবে গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে সেই দৃশ্যপটে পরিবর্তন এসেছে। ফলে তাকে কারাগারে পাঠানো হলেও নারায়ণগঞ্জের বিএনপির নেতৃবৃন্দ এবং কর্মী সমর্থকরাও গিয়াসের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তার মুক্তির দাবিতে সরব হয়েছেন রাজপথেও।