আজ শনিবার, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

এখনও চিহ্নিত হয়নি খুনি

সংবাদচর্চা রিপোর্ট :
স্বপ্না আক্তার। মেয়েটির বয়স ছিল ১৪। সে ছিল অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। অন্যান্য দিনের মতো ৩০ এপ্রিল স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল। ২ মে তার বস্তাবন্দি মরদেহ মিলে তদেরই বাড়ির কাছাকাছি একটি ময়লার স্তূপে। প্রথমে ধারণা করা হযেছিল, মরদেহটি কোনো এক নারীর। পরবর্তীতে তার মা-বাবা থানায় গিয়ে স্কুল ড্রেস দেখে মেয়ের লাশ শনাক্ত করেন।
এদিকে লাশ উদ্ধার ঘটনার দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনও পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারেনি তার হত্যার পেছনে কে বা কারা জড়িত। এছাড়াও কেন ওই কিশোরী খুন হলেন, সে রহস্য এখনও উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে নিহত স্বপ্না আক্তারের সঙ্গে থাকা স্কুলব্যাগের হদিস এখনও মিলেনি। একই সঙ্গে জানা যায়নি তার মরদেহ যে কাঁথা দিয়ে মোড়ানো ছিল সেই কাঁথার উৎস। সর্বোপরি কেন ওই কিশোরী খুন হলেন, কে বা করা তাকে হত্যা করলেনÑ সে রহস্য এতদিনেও উদঘাটন করতে না পারায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পুলিশী তদন্ত।
নিহত স্কুলছাত্রী সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী পশ্চিম পাড়ার দেলোয়ার হোসেন খোকার মেয়ে। সে স্থানীয় এমডব্লিউ স্কুলের ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল।
এদিকে স্কুল ছাত্রী স্বপ্না আক্তারের মরদেহ উদ্ধারের পর তার বাবা দেলোয়ার হোসেন খোকা ও মা শাহিনা আক্তারকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওইদিনই আটক করে। পরে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাদেরকে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় নিহতের বাবা ও মাকে নির্যাতন করার অভিযোগও রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। তবে, আটকের দুই রাত পর তথা ৪ মে তাদের দুজনকেই থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর আগে নিহতের মা শাহিনা আক্তারকে বাদী বানিয়ে একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ।
তবে, নিহতের মায়ের দাবি মামলায় কি লেখা ছিল তা তিনি জানেন না। পুলিশ সই করতে বলেছেন তিনি সই করেছেন। এর বেশি কিছু তিনি জানেন না। তবে, পুলিশ জানিয়েছে, স্কুল ছাত্রী হত্যার ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে আজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
নিহতের মা স্বপ্না আক্তার জানিয়েছেন, ৪ মে তারা থানা থেকে ছাড়া পেয়ে মেয়ের দাফন সম্পন্ন করেন। এদিন রাতে আবারও পুলিশ দেলোয়ার হোসেন খোকাকে আটক করে নিয়ে যায়। রাতভর তাকে থানায় আটকে রেখে নির্যাতনও করা হয়।
তিনি আরও জানিয়েছেন, পুলিশ তাদেরকে হত্যার দায় স্বীকার করতে নির্যাতন চালায়। বলা হয়েছিল, আমরা নাকি মেয়েকে মেরেছি। তা স্বীকার না করায় প্লাস দিয়ে আঙুলে চাপ দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। আঙুল দুদিন ফুলেও ছিল। ব্যথায় নাড়তেও পারি নাই।
এদিকে নিহত স্বপ্না আক্তার কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির ছিল। ফলে পুলিশের ধারণা তাকে শাসন করতে গিয়ে হয়তো বাবা মায়ের মারধরেই তার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ সূত্র আরও জানিয়েছে, তাদের বাড়ির রাস্তার একটি সিসি ক্যামেরাতে দেখা যায় মেয়েটি বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুলের দিকে যায়। পরে আবার সে স্কুল ছুটির পর বাড়ির রাস্তার দিকে ফিরে যায়। এরপর তাকে আর বের হতে দেখা যায়নি। ফলে ধারণা করা হচ্ছে তার নিজ বাড়িতেই সে হত্যার শিকার হয়েছে।
এদিকে লাশ উদ্ধারের দিন উপস্থিত থাকা প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, মেয়েটির মরদেহ একটি বস্তার ভেতরে কাঁথা দিয়ে মোড়ানো ছিল। বাইরের দিক দিয়ে বস্তাটি সেলাই করা ছিল। পরনে তার স্কুল ড্রেস থাকলেও সঙ্গে কোনো ব্যাগ ছিল না। গলার দিকে দুই তিনটি কাটা দাগ দেখা গিয়েছিল। চুল কিছুটা কাটা ছিল। তবে লাশটি পঁচে ফুলে গিয়েছিল বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। যে কারণে প্রথমে লাশটি কোনো একজন নারীর বলে মনে করেছিল সবাই।
শাহিনা আক্তার জানিয়েছেন, তিনি ইপিজেডের একটি গার্মেন্টে কাজ করেন। তার স্বামী দেলোয়ার হোসেন অসুস্থ থাকায় কাজকর্ম করতে পারেন না। তিনি বাড়িতেই থাকেন এবং দুই মেয়ের দেখাশোনা করেন। শনিবার বাড়ি এসে স্কুছাত্রী স্বপ্না আক্তারের দাফন সম্পন্ন করেন তারা। এদিন রাতে আবারও দেলোয়ার হোসেনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। স্বীকারোক্তি আদায়ে থানার ভেতর তাকে রাতভর নির্যাতন করা হয়।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ৩০ এপ্রিলের একটি সিসি টিভির ফুটেজে স্কুলছাত্রী স্বপ্নাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুলের দিকে যেতে দেখা যায়। আবার স্কুল ছুটির পর বাড়ির গলি দিয়েও তাকে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। এরপর তাকে আর ওই গলি দিয়ে বের হতে দেখা যায়নি। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, নিজ বাড়িতেই স্বপ্না আক্তারের হত্যা হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, স্বপ্না আক্তারের চলাফেরা অনেকটা উচ্ছৃঙ্খল ছিল। বেশ কিছু ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা শোনা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, বাবা মায়ের অবাধ্য ছিল মেয়ে। ঘটনার দিন হয়তো এসব নিয়ে শাসন করতে গিয়ে বাবা কিংবা মায়ের হাতে মৃত্যু হয় তার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দেলোয়ার হোসেন খোকার বাড়িটি টিনশেডের। একটি ঘরের সঙ্গে আরেকটি ঘর লাগোয়া। বাড়ির ভাড়াটিয়ারাও মারধরের কোনো ধরণের শব্দ পায়নি। তবে, একাধিক ছেলের সঙ্গে স্কুছাত্রীর সম্পর্কের বিষয়ে পুলিশের ধারণার সঙ্গে নিহতের মায়ের কথার কিছুটা মিল পাওয়া যায়। নিহতের মা শাহিনা আক্তারও জানিয়েছেন, তার মেয়ের কয়েকটি ছেলে বন্ধু আছে বলে তিনিও আন্দাজ করতে পেরেছেন। তবে সেই ছেলে বন্ধু কারা তা তিনি জানেন না। আর তার মেয়ের হত্যার সঙ্গে কোনোভাবেই তারা সম্পৃক্ত নন বলেও দাবি করেন।
তার পরিবারের সঙ্গে কারো বিরোধ আছে কিনা জানতে চাইলে শাহিনা আক্তার জানান, সাবেক কাউন্সিলর আলার পরিবারের সাথে জমি সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে। কিছুটা দূরের একটি নারিকেল গাছ দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমরা ওই গাছের নিচে শ^শুরের তৈরি বাড়িতে থাকতাম। গতবছর কাউন্সিলরের ছেলে আলামিন আমাদের বাড়ি ভেঙ্গে দেয়। শুনেছি, কাউন্সিলর নাকি আমার চাচা শ^শুরের কাছ থেকে জমি কিনেছে। এ নিয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে মামলা চলছে। একাধিকবার মিমাংসার জন্য ডেকেছিল কিন্তু আমার স্বামী জাননি। এর বেশি আমি আর জানি না।’
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহত স্বপ্নার এক নিকটআত্মীয় জানান, স্বপ্নার বাবা দেলোয়ার হোসেন খোকার আগের একটি সংসার আছে। সেই ঘরেও ছেলে-মেয়ে রয়েছে। নিহত স্বপ্না হচ্ছে দ্বিতীয় সংসারের বড় মেয়ে।
তবে সে যাহোক, কি কারণে ওই কিশোরী হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো। কে বা কারা তাকে হত্যা করলো। কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পূর্বের তার সঙ্গে কী এমন ঘটেছিল যে মেয়েটিকে খুনের শিকার হতো হলোÑ এসব বিষয় নিয়ে মানুষের মাঝে ব্যাপক কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ চায় হন্তারক যে বা যারাই হোক তাদেরকে দ্রুত সময়ের মধ্যে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ