সৈয়দ মোহাম্মদ রিফাত
আজ পহেলা মে। আজকের এই দিনটি আন্তজার্তিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। যা সচারচর মে দিবস হিসেবেই পরিচিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে আজ সরকারি ছুটির দিন। কোন কোন দেশে আবার বেসরকারিভাবেও দিনটি পালিত হয়। দিবসটি পালন করার মূল উদ্দেশ্য হলো শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়ন। অথচ, ১’শ ৩৩ বছর ধরে চলতে থাকা শ্রমিক আন্দোলন এখনোও বন্ধ হয়নি। কবে নাগাদ শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়ন করা হবে সে উত্তরটা অনেকেরই জানা নেই। এখনোও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে রাস্তায় নামতে দেখা যায়! বন্ধ হয়নি শিশু শ্রমও। আদৌ কি শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা পাবে কিংবা তাদের অধিকার বাস্তবায়ন হবে?
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হ্ েমার্কেটের ম্যাসকার শহীদদের আতœত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয় পহেলা মে’র দিনটি। ওইদিন দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে শ্রমিকরা হ্ েমার্কেটে জমায়েত হয়ে তাদের দাবী জানায়। শ্রমিকদের সাথে থাকা অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপের পরে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ওই ঘটনায় পুলিশ ও শ্রমিকসহ ১০-১২ জন লোক নিহত হয়। সেই থেকেই শুরু। আজকে ২০১৯ সাল অর্থ্যাৎ ১৩৩ বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরেও বন্ধ হয়নি শ্রমিক আন্দোলন। শত বছরেরও বেশি সময়ধরে চলতে থাকা শ্রমিক আন্দোলনে অজ¯্র খেটে-খাওয়া নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। এরপরেও সম্ভব হয়নি তাদের অধিকার বাস্তবায়ন করা। তাহলে এই ব্যর্থতা কার? প্রশ্নটা দিনের পর দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলা নিরীহ শ্রমিকদের।
১’শ ৩৩ বছরেও শ্রমিকদের অধিকার কেনো আদায় করা সম্ভব হয়নি? শ্রমিকদের এমন প্রশ্নের উত্তর খুজতে সাক্ষাৎকার নেয়া হয় শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে দায়িত্বরত শ্রমিক নেতাদের।
শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীর কমিটির সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ বলেন, বাস্তবতা হলো যে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন। আজকে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য অনেক কাজ করছেন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন ১৪০০ থেকে আজকে ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সেই সাথে বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করে যাচ্ছেন তিনি। বিশেষ করে আজকে বাংলাদেশের লেবার ফাউন্ডেশন, শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড তৈরী করা হয়েছে।
শত বছরের বেশী সময়ধরে আন্দোলন করার পরেও শ্রমিকরা রাস্তায় নামে কেনো? এখানে কার ব্যর্থতা বলে আপনি মনে করেন। এমন প্রশ্ন করা হলে শুক্কুর মাহমুদ আরও বলেন, আমাদের দেশের যারা মালিকপক্ষ তারা এগুলোকে মানেনা। প্রতিষ্ঠান তৈরী করে সেখান থেকে মুনাফা বের করাই তাদের মূল লক্ষ্য। অন্যদিকে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা পেলো কিনা সে দিকে তাদের কোন খেয়াল নেই। এইসকল সমস্যাগুলোর সমাধান করার জন্য আমরা সরকারের সাথে তৃপক্ষীয় বৈঠক করছি। শ্রমিকের অধিকার বাস্তবায়নে আমরা সবসময় কাজ করে যাচ্ছি।
সর্বপরি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে তার দাবী, নিরাপদ কর্ম পরিবেশের সাথে বাংলাদেশের প্রতিটি কল-কারখানার শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়ন হোক। শিশু শ্রম বন্ধ হোক, শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাক।
একি বিষয়ে জাতীয় শ্রমিক লীগের শ্রম ও কল্যান বিষয়ক সম্পাদক কাউসার আহমেদ পলাশ বলেন, যুগ যুগ শতাব্দীকাল যাবৎ শ্রমিকরা নির্যাতিত, অত্যাচারিত। কালের বির্বতনে শ্রমিকরা কখনো অধিকার পেয়েছে আবার কখনো বঞ্চিত হয়েছে। মালিক পক্ষ সবসময় শ্রমিকদের নির্যাতন, অত্যাচার করার জন্যই কোন না কোন কৌশল অবলম্বন করেছে। আর এসব করেই শ্রমিকদের ওপর জুলুম চালায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারের তরফ থেকে আজকে শ্রমিকদের জন্য যা করা হচ্ছে অন্য কোন সরকারের আমলে তা করা হয়নি। শ্রমিকরা যেগুলো পেয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোন শ্রমিকের পরিবারে যদি ভালো শিক্ষার্থী থাকে সেক্ষেত্রে ওই শিক্ষার্থী বিনা পয়সায় পড়াশোনা করতে পারবে। কোন শ্রমিক যদি মারা যায় তাহলে কল্যান ফাউন্ডেশন করা হয়েছে সেখান থেকে ২ লক্ষ টাকা পাবে। সেই সাথে কোন শ্রমিক যদি আহত হয় তাহলে তাকেও এককালীন সুবিধা দেওয়া হবে। সরকারের তরফ থেকে যে সুবিধাগুলো শ্রমিকদের জন্য দেয়া হয়েছে এখনও পর্যন্ত অনেক শ্রমিকরা তা জানে না।
বাংলাদেশের মালিক শ্রেণীর যে ব্যবস্থা তা অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক। এই ব্যবস্থাটা পরিবর্তন করতে হবে শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়ন করতে হলে। কারণ শ্রমিকরা এখনোও পর্যন্ত নির্যাতিত, অত্যাচারিত। এখনো পর্যন্ত শ্রমিকদের মালিকরা আপন করে নিতে পারে নাই। শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকরা এখনো পর্যন্ত অনেক জায়গায় বঞ্চিত। সর্বপরি একটা বিষয় হলো, শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে শ্রমিকরা এখনো পর্যন্ত একত্রিত হতে পারে নি। অন্যদিকে মালিকরা কিন্তু ঐক্যবদ্ধ। তাদের বিপদে তাদের সংগঠনগুলো কিন্তু পাশে এসে দাড়াঁয়। কিন্তু শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ না। এখানেই সবচেয়ে বড় সমস্যা।
শ্রমিকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে পলাশ বলেন, মালিকরা যেমন তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় একসাথে। তেমনিভাবে এই মে দিবস উপলক্ষে দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর শ্রমিকদের একত্রিত হতে হবে আগামী দিনে শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়ন করার জন্য।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি এডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল বলেন, যতদিন পর্যন্ত এই পুজিঁবাদি শাসন ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা বন্ধ না হবে ততদিন পর্যন্ত শ্রমিকদের শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যেতে হবে। শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই মে দিবসের চেতনায় সংগ্রাম করতে হবে। মে দিবস হচ্ছে শ্রমিক আন্দোলনের একটি বাতিঘর। এই দিবসটি আমাদের পথ দেখায়। সারা বিশ্বের শ্রমিকদের মাথা উচুঁ করে বাচঁতে শিখায়। বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণীকে এক পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানায়।
তিনি আরও বলেন, প্রথমত আমাদের দেশে যে শোষণ থেকে মুক্তির সংগ্রাম, রাজনৈতিক যে সংগ্রাম তা এখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি। যার কারণে প্রতিষ্ঠা হয়েছে পুজিঁবাদতন্ত্র। পুজিঁবাদের শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্র এখন পুজিঁবাদি শাসনতন্ত্রের পক্ষে কাজ করছে যার কারণে শ্রমিকদের অধিকার আদায় সম্ভব হয়নি। তবে, অধিকার আদায় না করার পেছনে শ্রমিক সংগঠনগুলোরও অনেক ব্যর্থতা রয়েছে।
মে দিবসে একজন শ্রমিক নেতা হিসেবে শ্রমিকদের প্রতি তার আহবান, শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে একটি পতাকাতলে একতাবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই অধিকার আদায় করা সম্ভব হবে।
সচেতন মহলের মতে, অনেক ব্যবসায়ী নেতা শ্রমিক আন্দোলনকে পুজিঁ করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। বর্তমান সরকার যদিও বলে তারা শ্রমিক বান্ধব সরকার কিন্তু শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ব্যবসায়ী শ্রমিক সংগঠনগুলোকে চাপ না দেওয়াতেই মূলত শ্রমিকদের দাবী আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এই সরকার শ্রমিকদের জন্য অনেক কিছুই করেছে। যার ন্যায় শ্রমিকদের বেতন সর্বশেষ ৮ হাজার টাকা নির্ধারন করা হয়েছিলো। তবে সরকারের উন্নয়ণ ও শ্রমিকদের আন্দোলনকে পুজিঁ করে তৃতীয় পক্ষ তথা কুচক্রী মহল ফায়দা লুটে নিচ্ছে। এদিকে সরকার হচ্ছে বিতর্কিত অন্যদিকে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ওইসকল ভালো মানুষের মুখোশে কালো মুখগুলোকে বের করলেই কেবল শ্রমিকদের অধিকার আদায় করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে নগরবাসীর মতে, শ্রমিক আন্দোলন কখনোই শেষ হবে না! শ্রমিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করে অন্যদিকে মালিকপক্ষ তাদের ঘারের ওপর বসে থেকে বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সার পাহাড় বানায়। শ্রমিকদের দেয় না তাদের ন্যায্য পাওনা। কেনো বিংশ’শতকে এসে শ্রমিকরা অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় দাড়াবে? এটা লজ্জার! শ্রমিকরা রক্ত, ঘাম এক করে শ্রম দিবে তার বিনিময়ে অর্থ নেবে। সংসার চালাবে, দুইবেলা দু’মুঠো খাবার খাবে। এটাই তো নিয়ম হওয়া উচিৎ। অথচ শ্রমের বিনিময়ে তারা পায় লাঞ্ছনা। পাওনা আদায়ের জন্য তাদের রাস্তায় নামতে হয়। কিন্তু কেনো?
তাদের মতে, সরকারকে শ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে ওইসকল মালিকদের যারা শ্রমিকদের পাওনা থেকে বঞ্চিত করে তাদের খুজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে তারা কখনোই শ্রমিকদের সাথে খেলার সাহস পাবে না। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোস দেখা দিয়েছে। এটা থেকে মুক্তি চায় শ্রমজীবী মানুষ।