আজ বৃহস্পতিবার, ১৪ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আড়াইহাজারের কালাপাহাড়িয়ার দায়িত্ব পালনে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন

সৈয়দ মোহাম্মদ রিফাত:
নারায়ণগঞ্জের ৫টি উপজেলার বেশ কিছু ভয়ানক জায়গার মধ্যে আড়াইহাজারের কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়ন অন্যতম। অন্য জায়গা থেকে আসা কোন মানুষ সেখানে প্রবেশ করলে রাতে তো দূরের কথা দিনের বেলাতেও চলাচল করতে ভয় পায়! জানা যায়, এলাকাটি সম্পূর্ণ দূর্গম একটি চর। এবং ওই এলাকার মানুষের হাতে কারণ ছাড়াই টেঁটা, রামদা, বগি ছাড়াও দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র থাকে। যার ফলে বাহির তথা অন্য কোন এলাকা থেকে কেউ সেখানে প্রবেশ করে না। দূর্গম চরাঞ্চল কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নে ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে এখন মাত্র ১৫ জন পুলিশ। টেঁটাযুদ্ধ, গুম, খুন, ডাকাতিসহ নানান ঘটনায় বারবার আলোচনায় মেঘনা নদী বেষ্টিত বিচ্ছিন্ন জনপদ কালাপাহাড়িয়া। কালাপাহাড়িয়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ভবনের আটটি জরাজীর্ণ কক্ষে চলে পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের কার্যক্রম। ভাঙা একটি টেবিল নিয়ে বসে থাকেন তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক নাদিরুজ্জামান।

সরজমিনে কালাপাহাড়িয়া ঘাট পেড়িয়ে প্রথমেই দেখা যায়, ভয়ংকর দৃশ্য। চারিদিকে গাছ-গাছালি নির্জন দৃশ্য নেই কোন মানুষ। কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের হাজীরটেক, বিবিরকান্দী, রাধানগর, কদমির চর, গোবিন্দপুর, বদলপুর, ইজারকান্দী নয়াগাঁও, পূর্বকান্দী, মধ্যারচর, ঝাউকান্দি, কালাপাহাড়িয়া, উলুয়াকান্দী ও খালিয়ার চরের বিভিন্ন শ্রেনীপেশার মানুষের সাথে কথা হয়।

পুলিশি সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে হাজীরটেক এলাকার কাইসসা ফকির জানান, পুলিশ ওনাদের কাছে কোন বিষয় না। ওই এলাকায় পুলিশ প্রয়োজন হয়না। ওনারাই যথেষ্ট।

বিবিরকান্দী এলাকার ইন্না মিয়া জানান, তাদের এলাকাতে পুলিশ কখনো আসতে দেখা যায়না। অনেক ঘটনা ঘটে কিন্তু তা এলাকার মুরব্বীদের দিয়েই শেষ হয়ে যায়।

রাধানগর এলাকার কদম আলী বলেন, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সেখানে পুলিশ উপস্থিত হয়। তাছাড়া সেখানকার মানুষ পুলিশকে তেমন গুরুত্ব দেয়না।

কদমির চর এলাকার খোরশেদ মসলা জানান, পুলিশের শক্তি সামর্থ্যে কম হওয়ায় পুলিশকে সেখানে কেউ দাম দেয়না। পাশাপাশি পুলিশের কোন প্রয়োজন তারা মনে করে না। সেখানে তারাই যথেষ্ট!

গোবিন্দপুর এলাকার মিশু জানান, পুলিশ কখনোই সেই এলাকাতে প্রবেশ করেনা। কিন্তু অনেক মর্মান্তিক ঘটনা সেখানে ঘটে।

বদলপুর এলাকার শাহিন জানান, এলাকাটি পুরোপুরি দূর্গম। পুলিশি সেবার খুবই প্রয়োজন সেখানে। কিন্তু ওই ইউনিয়নের পুলিশি জনবল সংকট। যার ফলে তারা প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা পায়না।

ইজারকান্দী এলাকার তুষার জানান, এই এলাকার মানুষ সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে। তাছাড়া সংঘর্ষে জড়িয়ে পরার পর তাদেরকে কেউ আটকাতে পারেনা।

নয়াগাঁও এলাকার হাসান জানান, একসময় বালুমহল নিয়ে এখানে অনেক ঝামেলা হতো। কিন্তু এখন আর তা হয়না। পূর্বের চেয়ে অনেকটা সংঘর্ষ কমে এসেছে। তারপরও পুলিশি সেবা থেকে বঞ্চিত তারা।

পূর্বকান্দী এলাকার ইনু জানান, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে বহু ঘটনা ঘটেছে সেখানে, এখনও ঘটে। এই ইউনিয়নে পুলিশের জনবল সংকট। এছাড়া পুলিশের পরিমাণ বাড়ানো হলেও সমস্যা সমাধান করা যাবে না বলে তিনি মনে করেন।

মধ্যরচর এলাকার শিবু জানান, কিছুদিন পূর্বে এই ইউনিয়নে ডিবির একজন লোক নিহত হয়েছিলো। এই বিষয়ে অনেক কিছুই হয়েছে কিন্তু আসামী গ্রেফতার হয়নি আর হবেও না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ এখানে সবচেয়ে বড় বিষয়। যার মাথায় রাজনৈতিক নেতার হাত আছে তিনিই এখানে সব।

ঝাউকান্দি এলাকার মীরু জানান, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ইউনিয়ন নিয়েই সবচেয়ে বেশী আলোচনা হয়েছে। কারণ এখানে প্রতিনিয়ত লাশ পাওয়া যায়। ভয়ে বাহির থেকে কেউ আসেনা এখানে।

কালাপাহাড়িয়া এলাকার ইকবাল জানান, ঘটনা ঘটার পর পুলিশের কাছে অভিযোগ দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় এখানকার মানুষ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে। বহু বছর ধরে এভাবেই চলছে। এর কোন স্থায়ী সমাধান দেওয়া হয়নি কৃর্তপক্ষের কাছ থেকে।

উলুয়াকান্দী এলাকার জিন্না জানান, পুলিশ তাদের সেবা দিয়ে মানুষের দৌড় গড়ায় পৌছাতে পারেনা। যার ফলে এখানকার মানুষের সাথে পুলিশের কোন সম্পর্ক নেই কিংবা তৈরী হয়নি।

খালিয়ার চর এলাকার খয়রুল জানান, হত্যা এই এলাকার একটি ধারাবাহিক বিষয়। এই বিষয়ের কোন সমাধান নেই । কারণ এখানে পর্যাপ্ত প্রশাসনিক চাপ নেই। যার ফলে যে যার মতো করে প্রভাব বিস্তারের জন্য যা খুশী করে। পুলিশ আসেও না কিছু করেও না।

জনবল সংকট সহ নানান সীমাবদ্ধতায় প্রত্যাশিত সেবা দিতে পারছে না কালাপাহাড়িয়া তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ। জানা যায়, একসময় খাগকান্দা পুলিশ ফাঁড়ির নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাটিতে জনসংখ্যা ও অপরাধ কর্মকান্ডে বেড়ে গেলে ২০১৫সালে কালাপাহাড়িয়ার তদন্ত কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়।

বিভিন্ন গণমাধ্যেম সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছরে ওই এলাকায় অধিপত্য বিস্তারের জেরে খুন হয়েছেন- সৌদিপ্রবাসী রাসেল মিয়া, পূর্বকান্দির আবদুর রব, মাদ্রাসা ছাত্রী শারমিন আক্তার, হাজিরটেক এলাকার জয়নাল আবেদীন, কদমীচরের আবদুস সালাম, আমান, লাল মিয়া, পুলিশ কনস্টেবল রুবেল মাহমুদ, সুজন মিয়া ও রোজিনা আক্তার। এছাড়াও ২০১১ সালে ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম স্বপন ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফাইজুল হক ডালিম গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মেঘনা নদীতে ডুবে মারা যান খাগকান্দা নৌফাঁড়ির এসআই নাসির সিরাজী। এ ছাড়াও গুম হয়েছেন খলিয়ারচরের শরীফুল ইসলাম শরীফ আর পঙ্গু হয়েছেন হাজিরটেকের সাইদুল, কালাপাহাড়িয়ার আবদুল বারেকসহ অনেকে।

উল্লেখ্য, উপরোক্ত ঘটনা ছাড়াও আরও অসংখ্যা খুন, গুমের ঘটনা রয়েছে কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের মধ্যে। যার আসামী ধরা কিংবা বিচার করা কোনটিই এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।

জানা যায়, সহিংসতার সময় এখানে ব্যবহার করা হয় টেঁটা, বল্লম, ছুরি, রামদাসহ বিভিন্ন দেশি অস্ত্র, বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র, ককটেলসহ কয়েক প্রকার বিস্ফোরক দ্রব্য। পুলিশ তৎপরতার অভাবে বর্তমানে এ এলাকায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের সমারোহ ঘটেছে। সন্ধ্যা হলেই অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় সশস্ত্র গ্রুপগুলো।

এ বিষয় আড়াইহাজার থানার ভাপপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার মোরশেদ দৈনিক সংবাদচর্চার নিজস্ব প্রতিবেদককে বলেন, ওই ইউনিয়নের চারদিকেই পানি। আমাদের যে মূল থানা সেখানে মাত্র ৫ জন উপ-পরিদর্শক ও ৭ জন সহকারী উপ-পরিদর্শক নিয়ে ১০টি ইউনিয়ন দুইটি পৌরসভা আমাদের নিয়ন্ত্রন করতে হয়। লোকবল ও জনবল তথা আমাদের যে চাহিদা এখন তো তারপরও হাজার হাজার পুলিশ নেয়াতে রক্ষা। এভাবেই আমাদের চলতে হচ্ছে কিছু করার নেই। তবে আমরা মোটামোটি সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি।

কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো: শওকত হোসেন সৈকত বলেন, এই এলাকাটি খুবই দূর্গম একটি এলাকা। আমি থাকাকালীন সময়ে পুলিশ ফাড়িতেও পর্যাপ্ত লোকবল ছিলো না। একটি কমিনিটি ক্লিনিকে পুলিশের ফাড়ি ছিলো। পুলিশ ফাড়ির জন্য আলাদা কোন ভবন ছিলো না।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) নজরুল ইসলাম বাবুকে বেশ কয়েকবার মুঠোফোন করা হলেও তিনি কোন গুরুত্ব দেননি।